
গ্লাস্টনবারি উৎসবে পাংক ব্যান্ড ‘নিক্যাপ’ ও ‘বব ভিলান’ পারফর্ম করে
পাংক ব্যান্ড বরাবরই ভদ্র সমাজের আরোপিত সীমা ভাঙার জন্য পরিচিত। মূলধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের ধর্ম। যদি তা না-ই করত, তবে তারা পাংকই হতো না। পাংক সংগীত কোনো আরামদায়ক জগতের স্বপ্ন দেখায় না– বরং তুলে ধরে সমাজের ভেতরের কলুষতা, ভণ্ডামি আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, বিচ্ছিন্নতা, প্রতিবাদ।
গ্লাস্টনবারি উৎসবে পাংক ব্যান্ড ‘নিক্যাপ’ ও ‘বব ভিলান’ ঠিক সেই কাজটিই করেছে– তারা গাজার গণহত্যার পেছনে থাকা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মুখোশ খুলে ফেলেছে দর্শকদের সামনে। আর এতেই শুরু হয়েছে এক সাজানো উন্মাদনা, রাজনৈতিক দ্বিচারিতা আর মিডিয়াচালিত ক্ষোভের তুফান।
গ্লাস্টনবারির এক রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে র্যাপার বব ভিলানের কণ্ঠে শোনা গেল পরিচিত স্লোগান– ‘ফ্রি, ফ্রি প্যালেস্টাইন’। দর্শকরা গলা মিলিয়েছেন, যা গ্লাস্টনবারি ও ব্রিটেনে ফিলিস্তিনের পক্ষে জনসমর্থনের একটি স্পষ্ট চিত্র। এরপর ভিলান বললেন, ‘এই স্লোগানটা শুনেছেন কখনও?’ উচ্চারিত হলো– ‘ডেথ, ডেথ টু দ্য আইডিএফ’; দর্শকরাও একসঙ্গে স্লোগানে সাড়া দেন। প্রসঙ্গত, আইডিএফ হলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভিলান বলেন, ‘আমরা অহিংস পাংক নই... কখনও কখনও বার্তা পৌঁছে দিতে হলে সহিংসতার ভাষাতেই বলতে হয়– কারণ কিছু মানুষের কাছে সেটাই একমাত্র বোধগম্য।’
তবে ভিলান কোথাও বলেননি যে, ইসরায়েলিদের মৃত্যু হোক– যেমনটি দাবি করেছে ডানপন্থি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইল। ২৯ জুন বিভ্রান্তিকর শিরোনামে তারা এমন মিথ্যা দাবি তোলে, যা তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে আরও একটি বিকৃত উদাহরণ হিসেবে যুক্ত হলো। এ স্লোগানের কারণে এখন ব্যান্ডটির যুক্তরাষ্ট্র সফরের ভিসা বাতিল হয়েছে, এজেন্টদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে, এমনকি শুরু হয়েছে পুলিশি তদন্ত।
নিপীড়নের বিরুদ্ধে চিৎকার
প্রায় দুই বছর ধরে গাজায় এক ভয়াবহ গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই প্রেক্ষাপটে আইডিএফ ধ্বংসের ডাক কোনো প্রতিশোধ নয়– বরং নিপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি। যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছে, সন্তানের লাশ কাঁধে তুলেছে, যারা অনাহারে মরছে, তাদের মুখে এই স্লোগান প্রতিবাদের ভাষা।
তারা শুধু এই যুদ্ধের অবসান চায় না, ভবিষ্যতের আগ্রাসন থেকেও মুক্তি চায়। প্রায় আট দশকের দখলদারিত্ব, উচ্ছেদ, বোমা হামলা ও অবরোধের পর তারা শুধু চায়– নিজ ভূমিতে নিরাপদে বাঁচতে। আইডিএফ-হীন একটি ভবিষ্যৎ।
বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষ ইসরায়েলের এই অপরাধ দেখে ক্ষুব্ধ। চিকিৎসক, সাংবাদিক, ত্রাণকর্মীরা গাজার মাটি থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে চলেছেন। কিন্তু পশ্চিমা সরকারগুলো– বিশেষত যুক্তরাজ্য এই গণহত্যার বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি, বরং মানবাধিকারের বুলি দিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে।
ব্রিটেনের সংস্কৃতিমন্ত্রী লিসা ন্যান্ডি গ্লাস্টনবারি উৎসব সম্প্রচার করায় বিবিসিকে কাঠগড়ায় তুলে বলেছেন, বব ভিলান ও নিক্যাপ-এর পারফরম্যান্স ‘জঘন্য ও অগ্রহণযোগ্য’। অথচ গাজায় দুই বছর ধরে চলা হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তাঁর মুখে একটি কথাও নেই। কোথায় ছিল তার এই নৈতিকতা যখন গাজা পুড়ছিল?
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এই সেই সেনাবাহিনী, যারা প্রায়ই ‘আরবদের মৃত্যু হোক’ কিংবা ‘ওদের গ্রাম পুড়ুক’ বলে প্রকাশ্যে উল্লাস করে।
ডেইলি মেইল যে বিকৃত খবর বানিয়েছে, সেটিই প্রমাণ করে ‘আইডিএফ-এর মৃত্যু হোক’– এই বক্তব্য তাদের পাঠকের জন্যও সম্ভবত খুব উসকানিমূলক মনে হয়নি। তাই তারা সেটি বিকৃত করে তুলেছে– যেন সেখানে ‘ইসরায়েলিদের মৃত্যু হোক’ বলা হয়েছে। ইসরায়েলের অর্ধেক নাগরিক কোনো না কোনো সময় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। এটি একটি সামরিকীকৃত রাষ্ট্র, যেখানে আইডিএফ সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিষ্ঠান। শাসকদের বড় অংশই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
গ্লাস্টনবারি উৎসবে পাংক ব্যান্ড ‘নিক্যাপ’ ও ‘বব ভিলান’ পারফর্ম করে
ভিলান কোনো নেতার মৃত্যু কামনা করেননি। তিনি বিশ্বের অন্যতম নিষ্ঠুর, শিশুহত্যাকারী এক সামরিক বাহিনীর অবসান চেয়েছেন– এমন বাহিনী, যা ক্যাফেতে ঢুকে সাংবাদিক-শিল্পীদের হত্যা করে, ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো ক্ষুধার্ত মানুষদের গুলি করে। ৩০ জুন আইডিএফ গাজার এক ক্যাফেতে বোমা মেরে হত্যা করে সাংবাদিক ইসমাইল আবু হাতাব, চিত্রশিল্পী ফ্রান্স আল-সালমিসহ আরও ৩১ জনকে। কিন্তু এই খবর ছিল না ডেইলি মেইলের প্রথম পাতায়।
সম্প্রতি ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ জানায়, গাজায় ভিড় করা ক্ষুধার্ত মানুষদের ‘শত্রু’ বলে ধরে নিয়ে সেনারা হামলা চালায় ভারী মেশিনগান, মর্টার ও গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে– যেখানে কোনো অস্ত্রধারী ছিল না, পাল্টা গুলি ছিল না।
ভয়ের রাজনীতি ও সত্যচাপা ক্ষোভ
গাজার গণহত্যা নয়– এখন ব্রিটিশ মিডিয়া আর রাজনীতি উত্তাল এক গায়কের স্লোগান ও বিবিসির সম্প্রচার নিয়ে। গ্লাস্টনবারির আয়োজক এমিলি এভিস এক বিবৃতিতে নিজেকে বব ভিলানের বক্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে বলেছেন, তারা ঘৃণা ও ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে লিসা ন্যান্ডি দাবি করেন– ‘ডেথ টু আইডিএফ’ মানে সব ইসরায়েলি ইহুদির মৃত্যুকামনা। লর্ড ইয়ান অস্টিন পুলিশের কাছে অনুরোধ করেন, ব্যান্ড সদস্যদের তদন্ত ও প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করতে।
৩০ জুন পুলিশ বব ভিলান ও নিক্যাপ-এর পারফরম্যান্স নিয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। অথচ বিশ্লেষকরা বলছেন– যে বাহিনী মানবাধিকার সংস্থার মতে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো ইহুদিবিদ্বেষ হতে পারে না। বরং একে ইহুদিবিদ্বেষ বলা নিজেই বিভ্রান্তিকর– এমনকি কখনও ইহুদিবিদ্বেষী হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তাতে ধরে নেওয়া হয় সব ইহুদিই আইডিএফের সঙ্গে একাকার।
ইসরায়েলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল ডেইলি মেইলকে বলেন, ‘তারা ইহুদি– তাই এটা সহ্য করা হচ্ছে।’ এই উসকানিমূলক বক্তব্যই সত্যিকার ভয়ের আবহ তৈরি করছে।
ইহুদি সমাজতান্ত্রিক কর্মী নাওমি উইম্বোর্ন-ইদ্রিসি বলেন, ‘ভিলান ইসরায়েলি জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বলেছেন– হত্যাকারী সেনাবাহিনীর মৃত্যু হোক। এ স্লোগান ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশে বিক্ষোভে ব্যবহৃত হচ্ছে। হয়তো এটি সংবেদনশীল নয়, কিন্তু যখন গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রকৃত ক্ষোভের ভাষা রুদ্ধ করা হয়, তখন এমন স্লোগানই জন্ম নেয়।’
এক বিবৃতিতে বব ভিলান বলেন, ‘আমরা কোনো জাতি বা ধর্মের বিরুদ্ধে নই– না ইহুদি, না আরব, না অন্য কেউ। আমরা চাই সহিংস সামরিক যন্ত্রের অবসান, যারা নিজেদের সেনাদের অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগের অনুমতি দেয়। আমাদের ইস্যু বানিয়ে সরকার দৃষ্টি সরাতে চাইছে– যাতে কেউ প্রশ্ন না তোলে, কেন তারা গণহত্যার সামনে দাঁড়িয়েও নীরব। আমাদের টার্গেট করা হচ্ছে, কারণ আমরা মুখ খুলেছি।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে কোনো পাংক ব্যান্ডের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাদের দরকার জবাবদিহি। এই সময় ‘আইডিএফ-এর মৃত্যু হোক’ কোনো ঘৃণার ভাষা নয়– এটি নিপীড়িত মানুষের এক করুণ আর্তি। প্রতিটি বিকৃতি, প্রতিটি ভণ্ডামো, প্রতিটি দমন এই আর্তিকে স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু যতই তারা চেষ্টা করুক, গান নিপীড়িতের ভাষা হয়ে ফিরে আসবেই।