
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের আগে থেকেই আন্তর্জাতিক তেলের বাজার অনিশ্চিত সময় পার করছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তেলের চাহিদা কমছে; কিন্তু এর মধ্যেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক+ জোট তেলের সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, রিয়াদ তেলের দাম ধরে রাখতে এবং বাজারে তাদের অংশীদারি হারানো রোধ করতে জোরালো অবস্থান নিচ্ছে। তবে এই কৌশল দীর্ঘ মেয়াদে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ তেলের মূল্যযুদ্ধ এখন আর শুধুই একটি বাজারগত ঘটনা নয়, বরং তাদের নিজস্ব অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
ওপেক+ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা চলতি বছর শরতে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেলেরও বেশি তেল বাজারে ফেরত আনার পরিকল্পনা করছে। এটা একটি বড় বদল, কারণ গত দুই বছর তারা তেলের দাম বাড়ানোর জন্য জোর দিয়ে সরবরাহ কমিয়ে আসছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫ সালে এই অতিরিক্ত সরবরাহ বিশ্ববাজারে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ লাখ এবং ২০২৬ সালে তা ১৫ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি।
এই সময়ে তেলের সরবরাহ বাড়ানো কিছুটা অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে কয়েক মাস ধরেই তেলের দাম কমে আসছিল। জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই দাম কমার ধারা এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং তখনই ওপেক+ এক ঝটিতি উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়, যা বাজারকে আরো অস্থির করে তোলে। এর পর থেকে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রায় ৮ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৬৯ ডলারের নিচে নেমে গেছে।
ওপেকের ইতিহাস বলছে, তারা বাজারের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণের জন্য তেলের দাম কমানো কিংবা বাড়ানো নিয়ে খেলছে। ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে ২০২০ সালের কোভিড মহামারির সময় পর্যন্ত তারা এমন কৌশল অবলম্বন করেছে, যা মূলত তাদের বাজার দখলের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে। ‘কেয়ারোস’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা অ্যান্টোইন হ্যালফ জানিয়েছেন, তারা মূলত উচ্চ খরচের উৎপাদকদের বাজার থেকে বাদ দেওয়ার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করে এবং কম খরচে উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
তেলের দাম যতই কম থাকুক, ৩৫ ডলারের নিচে গেলে সৌদি আরবের ক্ষতি হবে না। কিন্তু মার্কিন শেল তেলের জন্য বর্তমান দাম প্রায় ৬০ ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে, যা কিছু শেল উৎপাদকদের জন্য লাভের মার্জিন সংকুচিত করছে। অনেক মার্কিন উৎপাদক এই মূল্যের নিচে লাভের মুখ দেখছেন না। যার ফলে তারা উৎপাদন কমাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরব মার্কিন অপরিশোধিত তেল উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্প গ্যাসোলিনের দাম কমাতে চান, যা জনগণের পক্ষে সুবিধাজনক। আর গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তিনি প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৪০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে থাকুক, বিষয়টি পছন্দ করেন। এতে সৌদি আরব ও ওপেকের তেলের দাম কমানোর ‘সবুজ সংকেত’ মেলে।
বাজারে বেশি তেল সরবরাহের মাধ্যমে ইরাক, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য সদস্য দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে সৌদি, যারা নিয়মিত নিজেদের উৎপাদন কোটা অতিক্রম করে। এভাবে তারা জোটের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে তেলের দাম খুব বেশি কমানো তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
সৌদি আরব তাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যস্ত। এআই, চিপস, নিওম শহরের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পে বৈদেশিক পুঁজির প্রয়োজন আছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তারা বৈচিত্র্য আনতে চায়, তবুও তেল রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর তাদের নির্ভরতা এখনো বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, তাদের বাজেট ভারসাম্যের জন্য ব্যারেলপ্রতি ৯২ ডলারের দাম দরকার।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে সৌদির তেল থেকে রাজস্ব ১৮ শতাংশ কমে গেছে, অন্যদিকে তেলবহির্ভূত রাজস্ব মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের ধারণা, যদি বছরের গড় ব্রেন্ট দাম প্রায় ৬২ ডলারে থাকে, তাহলে দেশের বাজেট ঘাটতি দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। অর্থাৎ তারা বাজারে অংশীদারি ধরে রাখতে চাইলেও আর্থিক চাপের মধ্যে আছে এবং এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
বলাই চলে, সৌদির বর্তমান তেলের অতিরিক্ত সরবরাহ একটি চালাকি মাত্র, যা তারা তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য করছে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কতটা হবে, তা সময়ই বলবে।