Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ : যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১৪:২৬

ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ : যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?

ধনকুবের ইলন মাস্ক কিংবা ডেমোক্র্যাটদের প্রবল বিরোধিতা-কিছ্ইু যেন আটকাতে পারল না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেগাবিলের স্বপ্নকে। ২৯ ঘণ্টা বিতর্কের পর ৩ জুলাই কংগ্রেসে মার্জিন ভোটে অনুমোদন পায় ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’। নিঃসন্দেহে এই আইনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী করপোরেট আমেরিকা। ইউএস চেম্বার অব কমার্স এবং বিজনেস রাউন্ড টেবিলের মতো বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো এই বিলকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের উচ্ছ্বাসের প্রধান কারণ হলো ২০১৭ সালের ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্টের (টিসিজেএ) আওতায় পাওয়া কর ছাড়গুলো এই আইনের মাধ্যমে স্থায়ী করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোনো কোম্পানি যন্ত্রপাতি কিনলে তার পুরো খরচ প্রথম বছরেই আয়কর থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ, যা এখন পুনরুদ্ধার করা হলো। এ ছাড়া গবেষণা ও উন্নয়নের খরচও এখন থেকে এক বছরেই পুরোপুরি বাদ দেওয়া যাবে, যা বড় বড় কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করবে।

উৎপাদন শিল্প, বিশেষ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কারখানা তৈরি করতে চায়, তাদের জন্যও রয়েছে সুখবর। নতুন উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির খরচ এখন থেকে সম্পূর্ণ এবং তাৎক্ষণিকভাবে কর থেকে বাদ দেওয়া যাবে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ তৈরির শিল্পকে উৎসাহিত করতে এই খাতে দেওয়া ট্যাক্স ক্রেডিট আরো বাড়ানো হয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরাও এই বিলের কিছুটা সুফল পাবেন। 

তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন উচ্চ আয়ের মার্কিনিরা। পেন ওয়ারটন বাজেট মডেলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ২০ শতাংশ ধনী মানুষের বার্ষিক আয় গড়ে প্রায় ১৩ হাজার ডলার বেড়ে যাবে। আর যারা শীর্ষ ০.১ শতাংশ ধনী, তাদের বার্ষিক আয় বাড়বে গড়ে তিন লাখ ডলারের মতো! এমনকি টিপস ও ওভারটাইমের ওপর নির্ভরশীল কর্মীরাও নির্দিষ্ট আয়সীমার মধ্যে থাকলে কিছু বাড়তি কর ছাড়ের সুবিধা পাবেন।

কিন্তু এই বিলের ঠিক উল্টো পিঠে রয়েছে এক ধূসর বাস্তবতা। সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। মেডিকেইড (সরকারি স্বাস্থ্যবিমা) এবং ফুড স্ট্যাম্পের (খাদ্য সহায়তা) মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে ঐতিহাসিক কাটছাঁট করা হয়েছে। মেডিকেইডের ৬০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্রীয়ভাবে কাজের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে লাখ লাখ দরিদ্র মার্কিনি তাদের স্বাস্থ্যবিমা হারাতে পারে। একই নিয়ম আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে ফুড স্ট্যাম্প কর্মসূচিতেও, যেখানে এখন থেকে সুবিধা চালু রাখতে সক্ষম ব্যক্তিদের কাজ বা প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে।

কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের (সিবিও) মতে, এই কঠোর শর্তের কারণে দেশের সবচেয়ে কম আয়ের মানুষের বার্ষিক আয় গড়ে ১৬৫ ডলার কমে যাবে। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তদের একাংশও স্বাস্থ্যবিমা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। সব মিলিয়ে ২০৩৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিমাহীনের সংখ্যা অতিরিক্ত এক কোটি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই বিলের ফলে বড়সড় বিপাকে পড়েছে হাসপাতালগুলোও। মেডিকএইড খাতে সরকারি বরাদ্দ কমার কারণে তাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে এবং বিমাহীন রোগীদের চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। আমেরিকান হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের ভাষায়, ‘মেডিকএইড প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের এই কাটছাঁট আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অপূরণীয় ক্ষতি করবে।’

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বা ক্লিন এনার্জি শিল্পও এই আইনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিলটি বায়ু ও সৌরশক্তির মতো পুনর্বিকীরণযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে দেওয়া ট্যাক্স সুবিধাগুলো ২০২৭ সালের মধ্যে তুলে দেবে। একইভাবে ইলন মাস্কের মতো বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতারাও বড় ধাক্কা খাবেন, কারণ ক্রেতাদের জন্য সাড়ে সাত হাজার ডলার পর্যন্ত যে ট্যাক্স ক্রেডিট ছিল, তা খুব শিগগিরই বাতিল করে দেওয়া হবে।

সবশেষে যারা দেশের বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে চিন্তিত, তাদের কপালেও ভাঁজ ফেলেছে এই বিল। সিবিও-এর মতে, এই আইনের ফলে আগামী দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের বোঝা প্রায় ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে। এই বিপুল ঋণ সুদের হারকে আরো বাড়িয়ে দেবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ এবং ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধি করবে।

ট্রাম্পের এই ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ আদতে এক-দুই ধারী তলোয়ার। একদিকে এটি করপোরেট জগৎ এবং ধনীদের জন্য করের ছাড় আর মুনাফা বৃষ্টি নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে অসহায় মানুষের সামাজিক সুরক্ষা কেড়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এই আইনের সৌন্দর্য কার চোখে কতটা, তার বিচার ইতিহাসই করবে; কিন্তু এর ফলে মার্কিন সমাজে যে বিভাজন আরো গভীর হলো, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫