
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতি ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। পূর্বাভাসযোগ্য অস্থিরতা, শত্রুদের চমকে দেওয়া কৌশল এবং মিত্রদের দ্বিধায় ফেলা-এসব মিলিয়ে ট্রাম্প কার্যত একটি নতুন কূটনৈতিক নীতি তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায় এই নীতির নাম হচ্ছে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ বা ‘পাগল তত্ত্ব’। তার এই কূটনৈতিক নীতি নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে ‘পাগল তত্ত্ব’ বলতে বোঝানো হয়, একজন বিশ্বনেতা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের আচরণকে অস্থির ও অপ্রত্যাশিত হিসেবে উপস্থাপন করেন, যাতে শত্রুপক্ষ ভয় পেয়ে ছাড় দিয়ে দেয়। এই তত্ত্ব অনুসরণে ট্রাম্পই প্রথম নন। এর আগে ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই তত্ত্বটি কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেন। তিনি চেয়েছিলেন শত্রুপক্ষ, বিশেষ করে উত্তর ভিয়েতনাম, মনে করুক যে তিনি মানসিকভাবে অস্থির বা পাগল এবং যেকোনো সময় পারমাণবিক হামলার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে এক বার্তায় বলেছিলেন, ‘তাদের বলো আমি পাগলÑআমি কিছু করব, আর সেটা যেকোনো সময় হতে পারে।’
ট্রাম্পও মনে করেন, তার এই ‘পাগল তত্ত্ব’ কাজ করছে এবং এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের নিজের শর্তে আনতে পেরেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই ‘অনিশ্চয়তা’ই তার পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছর জুনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি ইরানে আক্রমণ করব কি না কেউ জানে না। আমি আক্রমণ করতেও পারি আবার নাও করতে পারি।’ তার এই মন্তব্যের কিছুদিন পরই তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা করেন, যা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক পিটার ট্রুবোভিটজ বলেন, ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিত্ব, রুচি ও মেজাজের ওপর নির্ভরশীল।’ ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহাসিক মিত্রদের বিরুদ্ধেও কড়া অবস্থান নিয়েছে। তিনি কানাডাকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য’ বলেছিলেন, গ্রিনল্যান্ড দখলের ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমনকি পানামা খাল পুনর্দখলের কথাও বলেছেন।
ন্যাটো সনদের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো সদস্য দেশের ওপর হামলা হলে বাকি সব সদস্য মিলে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে। যদিও ট্রাম্প সরাসরি এই নিয়ম ভাঙেননি, কারণ ইরান ন্যাটোর সদস্য নয়, তবুও মিত্রদের না জানিয়ে একতরফা ইরানে হামলা চালিয়ে তিনি ন্যাটোর ঐক্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। তার এমন আচরণে ইউরোপের দেশগুলো এখন আর আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করতে পারছে না। ব্রিটেনের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেশ এই পরিস্থিতিকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘অনুচ্ছেদ ৫ এখন লাইফ সাপোর্টে আছে।’
হোয়াইট হাউস থেকে ফাঁস হওয়া একাধিক বার্তায় দেখা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা ইউরোপীয় নেতাদের ‘ফ্রিলোডার’ বা পরাশ্রয়ী বলে আখ্যা দিয়েছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এক বার্তায় লেখেন, ‘আমি ইউরোপীয় ফ্রিলোডারদের প্রতি আপনার ঘৃণাকে পুরোপুরি সমর্থন করি।’ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের নিরাপত্তা রক্ষক নয়।’
এই আচরণের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো অভূতপূর্ব প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির পথে হেঁটেছে। মাত্র চার মাস আগে ব্রিটেন যেখানে জিডিপির ২.৩ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করত, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে। একই পথে হেঁটেছে ন্যাটোর অন্য সদস্যরাও।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ট্রুবোভিটজের মতে, ‘মাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন : ট্রাম্পের নির্বাচনী সেøাগান) গোষ্ঠীর কাছে চীন এখন রাশিয়ার চেয়ে বড় হুমকি, যা ইউরোপের জন্য সত্যি নাও হতে পারে।’ অথচ ন্যাটো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সামরিক ঐক্য গড়ে তোলা, যাতে তারা একে অপরকে সুরক্ষা দিতে পারে। ট্রাম্পকে পাঠানো এক বার্তায় ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট্টে লেখেন, ‘আপনার সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ ছিল অসাধারণ। আপনি যা অর্জন করেছেন, তা গত কয়েক দশকে আর কোনো প্রেসিডেন্ট পারেননি।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু বাজেট নয়, ইউরোপকে নিজস্ব অস্ত্রশিল্প, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও সামরিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি করতে হবে।
তবে সব ক্ষেত্রে এই কৌশল সফল নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ট্রাম্পের হুমকি-ধমকিকে পাত্তা দেননি। ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, পুতিন যুদ্ধ থামাতে রাজি না হওয়ায় তিনি ‘হতাশ’। ইরানও ট্রাম্পের হামলার প্রতিক্রিয়ায় আরো বেশি পরমাণু অস্ত্র অর্জনের দিকে ঝুঁকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ট্রাম্পের হামলা ইরানের সরকারকে দুর্বল না করে বরং আরো শক্তিশালী করতে পারে, যেমনটি ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের আক্রমণের পর হয়েছিল।
ট্রাম্পের কৌশল মিত্রদের মনে ভয় ঢুকিয়েছে। হয়তো অস্থায়ীভাবে তারা তার সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই কৌশল কতটা কার্যকর হবে তা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে এই কৌশল শত্রুদের বিরুদ্ধে কাজ করবে কি না, সেটিই এখন প্রশ্ন। তা ছাড়া যদি এই অনিশ্চয়তা আসলে ট্রাম্পের বাস্তব চরিত্রের প্রতিফলন হয়, তবে তা সময়ের সঙ্গে পূর্বাভাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।