Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

গাজায় যুদ্ধবিরতি কতদূর

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১৬:২৪

গাজায় যুদ্ধবিরতি কতদূর

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে গাজার শৈশব।

প্রায় ২১ মাস ধরে চলমান গাজা আগ্রাসনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও যখন শান্তির ক্ষীণ আলো দেখা দিচ্ছে, তখনই প্রশ্ন উঠছে-এটা কি সত্যিই যুদ্ধবিরতির শুরু, নাকি আরেকটি রাজনৈতিক ছলনা? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। আলোচকরা বসে স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পেতে পারেন বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি। হামাসও মধ্যস্থতাকারীদের কাছে সংশোধনসহ একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। কিন্তু তাতেও সংশয় কাটছে না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একদিকে হামাসের সংশোধিত প্রস্তাবকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে আখ্যায়িত করছেন, অন্যদিকে দোহায় আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তার যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন সফর নিয়েও বাড়ছে জল্পনা-চুক্তি হবে কি?

হামাসের তিন দাবি

১. গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) বন্ধ করতে হবে : ইসরায়েল সমর্থিত এই ত্রাণ কাঠামোটি কার্যত ক্ষুধাকে অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করছে। খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনিদের ওপর 

ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানো হয়েছে-এমন তথ্য প্রকাশ পেয়েছে ইসরায়েলভিত্তিক সংবাদমাধ্যম হারেৎজ পত্রিকায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচারের ভাষায়, ‘জিএইচএফ ক্ষুধাকে এক ধরনের রাজনৈতিক দরকষাকষির হাতিয়ার বানিয়েছে। এটি সহিংসতার ওপর একটি পাতলা পর্দা মাত্র।’

২. ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার : হামাস চায়, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির আগের অবস্থানে ফিরে যাক। মার্চে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর ইসরায়েল গাজায় নতুন করে স্থল অভিযান শুরু করে এবং ‘নেটজারিম করিডর’ ও ‘মোরাগ করিডর’ নির্মাণের মাধ্যমে গাজার ভৌগোলিক বিভাজন ঘটায়। এই সেনা মোতায়েন বন্ধ ও আগ্রাসনের অবসানই হামাসের প্রধান শর্ত।

৩. যুদ্ধের স্থায়ী অবসানে আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা : ইসরায়েল এর আগে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। তাই হামাস এবার এমন একটি চুক্তি চায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য প্রভাবশালী শক্তি নিশ্চয়তা দেবে-যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল আর আগ্রাসন চালাতে পারবে না। এটি কেবল যুদ্ধ বন্ধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার প্রশ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনায় যা আছে

এই যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে গাজায় আটক ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির প্রশ্ন। হামাস ১০ জন জীবিত ও ১৮ জনের মৃতদেহ ফেরত দেবে, বিনিময়ে ইসরায়েল শত শত ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সম্পন্ন হবে। বর্তমানে গাজায় প্রায় ৫০ জন ইসরায়েলি বন্দি রয়েছে, যাদের মধ্যে আনুমানিক ২০ জন জীবিত। ত্রাণ সহায়তার প্রশ্নে প্রস্তাবে জাতিসংঘ ও রেডক্রসকে খাদ্য ও জরুরি সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজার কিছু অংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে বলেও উল্লেখ আছে।

নেতানিয়াহুর অবস্থান

নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে এই প্রস্তাবের কিছু অংশে সম্মত হলেও হামাসের সংশোধনী তার কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য’। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, যুদ্ধ চলবে যতক্ষণ না সব ইসরায়েলি বন্দি মুক্ত হবে এবং হামাস ‘ধ্বংস’ হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ‘ধ্বংস’ নীতি একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র, যার মাধ্যমে নেতানিয়াহু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে তার দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে চান এবং জনপ্রিয়তা আদায়ের চেষ্টা করছেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের অভিযানে নিরাপত্তা ব্যর্থতার দায়েও তিনি ইসরায়েলি সমাজে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। তার এই যুদ্ধনীতিকে উসকে দিচ্ছে উগ্র ডানপন্থি জোটসঙ্গীরা-এর মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ অন্যতম। তাদের লক্ষ্য একটাই-আরো আগ্রাসন, আরো মৃত্যু এবং সব ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ।

মৃত্যু, ক্ষুধা ও প্রতিরোধ

গাজায় প্রতিদিন চলছে বোমাবর্ষণ, যার সর্বশেষ উদাহরণ ৬ জুলাই-মাত্র ২৪ ঘণ্টায় নিহত হন অন্তত ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি। অধিকৃত পশ্চিম তীরেও পরিস্থিতি ভয়াবহ। ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে এবং ইসরায়েলি সেটলারদের হামলায় প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ৭ অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি। মানুষের চলাচল, খাদ্য, চিকিৎসা-সবই সেখানে এখন দুঃস্বপ্ন।

ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী, হয়তো নিজেকে শান্তির কাণ্ডারি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। গাজার মানুষ শান্তি চায়, বেঁচে থাকার অধিকার চায়। তবু সবচেয়ে বড় বাধা হলো ইসরায়েল নিজেই। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদনান হায়াজনেহ বলেন, ‘ইসরায়েল ও নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী নন। তাদের লক্ষ্য একটাই-একটা ভূখণ্ড, কিন্তু সেখানে কোনো ফিলিস্তিনি থাকবে না।’ তার মতে, ফিলিস্তিনিদের সামনে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে-১. ক্ষুধায় মারা যাওয়া, ২. বোমায় নিহত হওয়া এবং ৩. দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা আবারও প্রমাণ করেছে, তারা নিজেদের ভূমি ছেড়ে যাবে না।’

ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অগ্রগতি হলেও এর বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ইসরায়েলের সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক চাপের ওপর। নেতানিয়াহুর রাজনীতি এবং তার ডানপন্থি জোটসঙ্গীদের যুদ্ধোন্মাদ অবস্থান এই সম্ভাবনাকে দুর্বল করে তুলছে। গাজার ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা শিশু, বৃদ্ধ ও ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তাই প্রশ্ন রয়ে যায়-এই যুদ্ধ কি থামবে? নাকি ট্রাম্পের প্রস্তাব হবে আরেকটি ‘ভালো খবরের’ মোড়কে আড়াল করা নিষ্ঠুর বাস্তবতা?


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫