Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

যে কারণে তালেবানকে স্বীকৃতি দিল রাশিয়া

Icon

মোকাররম রানা

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৩:২২

যে কারণে তালেবানকে স্বীকৃতি দিল রাশিয়া

সশস্ত্র তালেবান সদস্য।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। ৩ জুলাই এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তালেবানশাসিত কাবুল সরকারকে প্রথম কোনো দেশ স্বীকৃতি দিল। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। এই স্বীকৃতি দেওয়ার দিন মস্কো জানায়, এই সিদ্ধান্ত ‘দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় নতুন গতি আনবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নতুন নয়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মস্কো পরিকল্পিতভাবে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। এর পেছনে রয়েছে রাশিয়ার নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ।

২০১৫-১৬ সালে রাশিয়া তালেবানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের চ্যানেল চালু করে। এক তালেবান কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানানো হয়, দলটির রাজনৈতিক দপ্তরের সদস্যরা তখন গোপনে রাশিয়া সফর করেন। তালেবান আফগানিস্তান দখলের পর রাশিয়া শুধু সম্পর্ক বজায় রাখেনি, বরং তাদের সরকার পরিচালনা, সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থা ও মানবাধিকার উন্নয়নের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে আসছে, যাতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হয়।

পাকিস্তানে সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমদ খান বলেন, “রাশিয়ার এই স্বীকৃতি একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল, যেখানে তারা ১২ বছর ধরে তালেবানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরপর ‘মস্কো ফরম্যাট’ নামে একটি আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম চালু করে এবং তালেবানকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করে।”

সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা নিয়ে উদ্বেগ

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর রাশিয়া আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার চায়, যারা ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) ও মাদক পাচার প্রতিরোধ করবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় চরমপন্থা ও উগ্রবাদের বিস্তার থেকে মধ্য এশিয়াকে রক্ষা করবে। রাশিয়া চায় না, আফগানিস্তান আবার যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা জোটের প্রভাব বলয়ে চলে যাক। মস্কোভিত্তিক আফগান বিশ্লেষক ড. শের হাসান বলেন, ‘রাশিয়া চায় না আফগানিস্তান আবার যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের হাতে পড়ুক। প্রতিটি দেশই চায় তাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, অন্তত যাতে আফগানিস্তান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়। যুক্তরাষ্ট্রও একই লক্ষ্যেই কাজ করছে, যা নিয়ে রাশিয়া উদ্বিগ্ন। তাই রাশিয়া চায় তালেবানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের দূরে রাখতে। রাশিয়া কখনই চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করুক বা কৌশলগত অস্ত্র মোতায়েন করুক। এটা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে।’

একই সঙ্গে মস্কো চায় তাদের মধ্য এশীয় মিত্রদের সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থি মতাদর্শ থেকে রক্ষা করতে। ড. হাসান বলেন, ‘যদি এই চরমপন্থি মতাদর্শ মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এবং সেখান থেকে রাশিয়ায় পৌঁছায়, তবে রাশিয়ার ক্ষতি হবে এবং তা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।’

মধ্য এশিয়ার দেশগুলো ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া ও আফগানিস্তানের মাঝে অবস্থান করছে। তারা তালেবান সরকারের প্রতি সতর্ক অবস্থান নিয়েও আঞ্চলিক সংযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মার্কিন শিক্ষাবিদ এবং আফগান বংশোদ্ভূত গবেষক ড. উবাইদুল্লাহ বুরহানি বলেন, ‘রাশিয়ার এই স্বীকৃতি কেবল প্রতীকী নয়। এটা একটি কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে তালেবানকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং মধ্য এশিয়ায় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার রোধ করাই রাশিয়ার লক্ষ্য। এই স্বীকৃতি তালেবানকে তাদের শাসনব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করতে পারে-বিশেষত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠন, নারীদের শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে।’

তিনি মনে করেন, এই পদক্ষেপ আফগানিস্তানে চলমান স্থবিরতা ভাঙতে ভূমিকা রেখেছে, যেখানে না কোনো সংস্কার হচ্ছে, না কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠছে।

বিরোধিতা

তালেবানবিরোধী নেতারা রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য উপেক্ষা করে তারা এই ইস্যুতে ঐক্য প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ‘একটি বিপজ্জনক খেলা’ এবং এটি আফগানিস্তানকে ঘিরে নতুন একটি বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা করতে পারে। তালেবানবিরোধী ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) রাশিয়ার সিদ্ধান্তকে ‘তালেবানের সন্ত্রাসী অংশীদার ও অপরাধ চক্রগুলোর জন্য এক বড় সুবিধা’ বলে উল্লেখ করেছে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে। এনআরএফের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘একটি অবৈধ সরকারকে আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি দেওয়ার এই প্রচেষ্টা কেবল আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। এটি সন্ত্রাসবাদ, অপরাধপ্রবণ অর্থনীতি এবং মাদক ও অস্ত্র পাচারকে স্বাভাবিক ও উৎসাহিত করবে।’ 

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির পথে

তালেবান সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য হবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এবং জাতিসংঘে একটি আসন অর্জন। সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মনসুর আহমদ খান বলেন, রাশিয়ার স্বীকৃতি আফগানিস্তানের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ারই অংশ। তবে তিনি মনে করেন, তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া এখনো একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।

এক বড় বাধা হলো, তালেবান এবং তাদের অনেক নেতার নাম এখনো সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক তালিকায় রয়েছে। জাতিসংঘ বা ওআইসিতে আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দিতে হলে এই তালিকা থেকে তাদের নাম সরাতে হবে। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের আরোপিত অর্থনৈতিক ও ব্যাংক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করতে হবে।

এদিকে তালেবানদের নিজেদের কর্মকাণ্ডও (বা নিষ্ক্রিয়তা) বৈশ্বিক স্বীকৃতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারীদের অধিকার হরণ এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনে ব্যর্থতা বিদেশি শক্তিগুলোকে বিরূপ করে তুলেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫