
গ্রীষ্মের দাবদাহে আশ্রয়হীন অসহায় গাজা। ছবি : সংগৃহীত
একসময় গাজায় গ্রীষ্ম মানেই ছিল উচ্ছ্বাস, রৌদ্রছায়া, সমুদ্রের ঢেউ আর উঠানে বসে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বিকেল কাটানো। কিন্তু আজ সেই গ্রীষ্ম আর আনন্দের নয়-এখন তা ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর শোকের মৌসুম। সূর্য যেন গাজাবাসীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক নীরব ঘাতক। এই গ্রীষ্মে পশ্চিম ইউরোপে ‘অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহ’ নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন-কীভাবে সরকার মানুষকে এই দাবদাহ থেকে রক্ষা করছে; ঘরে অবস্থান করা, পানি পান করা, সানস্ক্রিন ব্যবহার করা বা কায়িক শ্রম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
গাজাবাসীর কাছে এই আতঙ্ক দেখে এক তিক্ত হাসি চাপিয়ে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করতেই সেখানে এখনো যা অবশিষ্ট আছে, তা এক উন্মুক্ত চুল্লিতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রচণ্ড গরম, আর্দ্র গ্রীষ্মে গাজার মানুষের এমনকি ন্যূনতম আশ্রয় বা সুরক্ষা পাওয়ারও উপায় নেই। ইউরোপে মানুষ ঘরে থাকতে পারে, হাইড্রেটেড থাকতে পারে, ছাতা মেলে বাইরে যেতে পারে। এর বিপরীতে গাজাবাসী ঘরহীন, পানিহীন, ছায়াহীন, আশ্রয়হীন।
বাইরে না থাকার পরামর্শ শুনে তাদের হতবাক হতে হয়-তাদের তো বাইরে যেতেই হয়, বেঁচে থাকার জন্য। ‘হাইড্রেটেড’ থাকা সেখানে বিলাসিতা-পানি কেবল দুষ্প্রাপ্যই নয়, তা প্রায়ই দূষিত। আর সানস্ক্রিন? মঙ্গল গ্রহে ওষুধ পাওয়াটাও হয়তো এর চেয়ে বেশি সহজ।
একসময় গাজায় গ্রীষ্ম মানেই ছিল সমুদ্রস্নান, উঠানের ছায়া, গাছতলার হাওয়া। আজ তা রূপ নিয়েছে মৃত্যুর মৌসুমে। সৈকতগুলো অবরুদ্ধ, উঠানগুলো ধ্বংসস্তূপ, গাছগুলো পুড়ে ছাই। ইসরায়েল গাজার বেশির ভাগ অঞ্চল ধ্বংস করে দিয়েছে। মাটি হয়েছে ধুলা, পার্ক হয়েছে মরুভূমি, শহর হয়েছে কবরস্থান। গাজা এখন এক ছায়াহীন নগরী। এই দাবদাহ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়-এটি মনুষ্যসৃষ্ট, পরিকল্পিত। ইসরায়েলের টানা বোমাবর্ষণ শুধু ধ্বংসই আনেনি, সৃষ্টি করেছে ঘন ধোঁয়ার স্তর, দূষণ, অগ্নিকাণ্ড আর অপ্রতিরোধ্য উষ্ণতা। ফেলে রাখা আবর্জনা পচে যাচ্ছে সূর্যের তাপে, কৃষিজমি মুছে যাচ্ছে মানচিত্র থেকে। জলবায়ু সংকট নয়-এ এক নির্মম জলবায়ু নিপীড়ন।
একদিকে ইউরোপের তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী ‘হিট ডোম’-আকাশে আটকে থাকা উত্তপ্ত বায়ুর স্তর। অন্যদিকে গাজাবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আরেক রকমের গম্বুজ-নাইলনের তৈরি শিবিরের তাঁবু, যেগুলো সূর্যের নিচে ধীরে ধীরে সেখানকার অধিবাসীদেরই রান্না করে ফেলছে। গাজার আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত চিকিৎসক কাসেম ওয়ালিদের মতে, “এগুলো ‘আশ্রয়’ নয়, এগুলো গ্যাসচেম্বার; এখানে তাপ আটকে থাকে, ঘাম জমে, কান্না শুকায় না। আমার জন্য এখন গ্রীষ্ম আর কোনো প্রতীক্ষার ঋতু নয়, এটি এক দুঃস্বপ্নের ঘূর্ণিপাক। সূর্য যেন মাথার ওপর ঝুলে থাকা এক মৃত্যুদণ্ড। তাঁবুর ভেতর দিনের বেলায় নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন, বাইরে দাঁড়ানো যায় না সূর্যের প্রখরতায়। তবুও বের হতে হয়-কখনো পানির লাইনে, কখনো খাবারের লাইনে। সূর্য মাথার ওপর, শরীর অবসন্ন, সন্তানেরা ক্ষুধার্ত; তখন আর শৃঙ্খলার বোধ থাকে না, থাকে শুধু বাঁচার তাড়না। কেউ কেউ বলে, আমরা কেন হুড়োহুড়ি করি। তারা জানে না-এটা লোভ নয়, এটা জীবন রক্ষার লড়াই। আমাদের জ্বালানি বলতে এখন কাঠ, শুকনো পাতা এমনকি পোড়া প্লাস্টিক। সেগুলো জোগাড় করে ফিরে আসি তাঁবুতে-আরো গরম, আরো ক্লান্তি নিয়ে।”
এখন ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চালু করা প্রহসন চলছে, সেখানে আটা দেওয়া হয় ধাতব খাঁচার ভেতর। যেন গাজাবাসী মানুষ না, কোনো জন্তু-জানোয়ার। মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ছায়া নেই, সম্মান নেই। সৈন্যরা চিৎকার করে বলে, টুপি খোলো, রাস্তায় মুখ থুবড়ে শুয়ে পড়ো, হামাগুড়ি দিয়ে খাবার নাও। তবুও সবার কপালে কিছু জোটে না। ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো গুলি খেতে হয়। তাদের অস্তিত্বের মানদণ্ড নেমে এসেছে ন্যূনতমে; তারা আর আশ্রয়, নিরাপত্তা চায় না। শুধু জিজ্ঞাসা-আজকের খাবার জুটবে তো?
ইসরায়েল গাজাবাসীর ওপর প্রয়োগ করেছে নিষ্ঠুরতার সব অস্ত্র-রোদ কিন্তু ছায়া নেই, তৃষ্ণা কিন্তু পানি নেই, ক্ষুধা কিন্তু খাবার নেই। বিদ্যুৎ নেই, পাম্প চালানোর জ্বালানি নেই, বরফ নেই। মাছ নেই, বাজার নেই। অনেকের জন্য এই গ্রীষ্ম হয়তো জীবনের শেষ গ্রীষ্ম। এটা কোনো জলবায়ু সংকট নয়। এটা আবহাওয়াকে যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করার এক নিষ্ঠুর কৌশল, যেখানে বোমা বা গুলির চেয়েও নির্মম হয়ে ওঠে সূর্য, তৃষ্ণা, ধীর মৃত্যুর যন্ত্রণা।