ইসরায়েলি হামলায় প্রশ্নবিদ্ধ সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১১:৫৮

দ্রুজ জনগোষ্ঠিকে রক্ষার অজুহাতে সিরিয়ার সামরিক সদর দপ্তরে ইসরায়েলের হামলা - ছবি : রয়টার্স
সিরিয়ার দামেস্কে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলি হামলা-এ সপ্তাহের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই হামলার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘু দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করার মানবিক দায়বদ্ধতা। কিন্তু এই আপাত মানবিক কারণের গভীরে লুকিয়ে আছে এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ। যেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, একটি নতুন সরকারের দুর্বলতা এবং ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ এক সুতায় গাঁথা।
ঘটনাটির সূত্রপাত সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে দ্রুজ ও বেদুইন গোষ্ঠীর মধ্যে একটি স্থানীয় সংঘর্ষ থেকে। কিন্তু যখন ওই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সিরিয়ার নতুন সরকার সেনা পাঠায় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তখন খুব দ্রুতই এই সংঘাত একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয়। এই ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বাশার আল-আসাদ পরবর্তী সিরিয়া কতটা ভঙ্গুর এবং এর ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ তাদের দেশের দ্রুজ নাগরিকদের সঙ্গে ‘রক্তের বন্ধন’-এর কথা উল্লেখ করে এই হামলাকে ন্যায্যতা দিয়েছেন। ইসরায়েলে বসবাসকারী দ্রুজরা সে দেশের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করে, যা এই সম্পর্ককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিয়েছে। কিন্তু এই মানবিক দাবির পাশাপাশি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্যটিও স্পষ্ট। আসাদের পতনের পর সৃষ্ট ক্ষমতার শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল এর আগেও সিরিয়ার সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করার জন্য শত শত হামলা চালিয়েছে। আসাদের পতনের পর ইরানের প্রভাব খর্ব করা এবং হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সি গোষ্ঠীর সরবরাহ পথ বিচ্ছিন্ন করা ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। দ্রুজদের সুরক্ষার আড়ালে তাদের সেই পুরোনো কৌশলেরই বাস্তবায়ন দেখা গেল।
অন্যদিকে এই ঘটনা সিরিয়ার নতুন সরকারের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। আসাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসা সাবেক ইসলামপন্থি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন এই সরকার শুরু থেকেই দ্রুজসহ অন্য সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু দ্রুজদের ওপর সিরীয় সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভিডিও এবং পুরোনো হয়রানির অভিযোগগুলো প্রমাণ করে যে, নতুন শাসকের প্রতি সংখ্যালঘুদের ভয় ও অবিশ্বাস এখনো কাটেনি। সিরিয়ার নতুন সরকারের জন্য এই ঘটনাটি একটি জটিল ও দ্বিমুখী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একদিকে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হওয়ার এবং ইসরায়েলের মতো বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে, অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় থাকলে নিজেদের দুর্বলতা এবং দেশ পরিচালনায় অযোগ্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার ‘সিরিয়া সবার’-এই আশ্বাসবাণী তাই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দ্রুজ সম্প্রদায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক নিঃশব্দ কিন্তু প্রবল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এক বিস্মৃত জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের অবস্থান যেন সব সময়ই এক ধূসর রেখায়-না পুরোপুরি শক্তিশালী, না পুরোপুরি নিপীড়িত।
তারা ছড়িয়ে আছে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ইসরায়েলজুড়ে; কিন্তু কোনো রাষ্ট্রেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, ফলে প্রতিনিয়ত তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখার জন্য এক ধরনের আপস, বুদ্ধিদীপ্ত নিরপেক্ষতা এবং তাৎক্ষণিক স্বার্থানুসারী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসনামলে দ্রুজরা মোটামুটি নিরাপদ অবস্থানে ছিল। তারা সরাসরি বিরোধিতায় না গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ন্যূনতম বোঝাপড়া রক্ষা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আসাদ-পরবর্তী সম্ভাব্য সিরিয়া, যেখানে কেন্দ্রীভূত শাসন ভেঙে পড়ে ছোট ছোট গোষ্ঠী ও শক্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, সেখানে এই পুরোনো কৌশল আজ কার্যত অচল হয়ে পড়ছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইসরায়েলি দ্রুজরা যখন সিরিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে তাদের জাতি-ভ্রাতাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে যায়, তখন সেটা শুধু মানবিকতার জায়গা থেকে নয়; বরং এটা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানেরও জানান দেয়।
এই জটিল পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারা একদিকে নতুন সিরীয় সরকারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ দিচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্থাপনের চেষ্টা করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর এই ঘটনাকে ‘ভুল-বোঝাবুঝি’ বলে আখ্যা দেওয়া এবং দ্রুত উত্তেজনা প্রশমনের ওপর জোর দেওয়া থেকে বোঝা যায়, ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে নতুন করে কোনো বড় সংঘাত চায় না। তবে নেতানিয়াহুর দাবি, ‘শক্তির মাধ্যমেই’ যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়েছে, যা মার্কিন ও আরব মধ্যস্থতার ভূমিকাকে কার্যত অস্বীকার করে। এই ঘটনা সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। একটি নবগঠিত সরকার যখন নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক সংঘাত মেটাতে বিদেশি মধ্যস্থতার (মার্কিন, আরব, তুর্কি) ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং একই সময়ে ইসরায়েলের মতো একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডে অবাধে হামলা চালিয়ে নিজের শক্তি জাহির করে, তখন রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি হয়।