দুর্ধর্ষ নারী স্নাইপার লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০৩

২২ জুন ১৯৪১, রাত ১২টা। ৩০ লাখ জার্মান সেনা, ২০০০ লুফটওয়্যাফ যুদ্ধবিমান এবং হাজার হাজার ট্যাংক ঢুকে পড়ল ইউক্রেনে। শুরু হয়ে যায় অপারেশন ‘বারবারোসা’। এর মধ্য দিয়েই ১৯৩৯ সালে স্ট্যালিন ও হিটলারের ‘মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি’ অর্থাৎ ‘জার্মানি-সোভিয়েত অনাক্রমণ চুক্তি’ ভেঙে যায়। বিশ্ব সাক্ষী হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে আলোচিত আগ্রাসনের।
সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানির আগ্রাসন যখন পুরোদমে চলছে তখন সোভিয়েত রেড আর্মিতে অজস্র তরুণ-তরুণী নাম লেখান। কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী ২৪ বছরের লুডমিলা মিখাইলভনা পাভলিচেঙ্কো ছিলেন তেমনই একজন। নিয়মমাফিক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং স্নাইপার রাইফেল চালানোর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোকে ‘৭.৬২ মিমি মোসিন-নাগান্ট রাইফেল’ দেওয়া হলো। রাইফেলটি এক হাজার ২৫০ মিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যভেদে সক্ষম ছিল। ‘রেড আর্মির ভিআই চাপায়েভ ২৫তম রাইফেল ডিভিশনে নিযুক্ত করা হয় লুডমিলাকে। ২৫তম রাইফেল ডিভিশন ইতিমধ্যেই মলদোভায় জার্মানি-রোমানিয়ার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যেকোনো মূল্যে জার্মানির বাহিনীকে দক্ষিণের ওডেসার দিকে অগ্রসর হওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করছিল। ওডেসায় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর এবং নৌঘাঁটির স্থান।
জার্মানি-রোমানিয়ার বাহিনী ভারী আর্টিলারি থেকে ওডেসায় ব্যাপক গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং তাদের পদাতিক বাহিনী সোভিয়েত প্রতিরক্ষাব্যুহের মূল লাইনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এ সময় শত্রুপক্ষের অগ্রযাত্রার গতি কমাতে এবং মনোবল ভেঙে ফেলতে লুডমিলাসহ অন্যান্য সোভিয়েত স্নাইপারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। লুডমিলা এই সুযোগটির পূর্ণ ব্যবহার করেন। তার অব্যর্থ নিশানায় প্রথম দুই মাসে শত্রুপক্ষের ১৮৭ জন সেনা মৃত্যুর মুখে পতিত হন। তার এই অসাধারণ দক্ষতার গল্প দ্রুতই সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোভিয়েত নারীরা স্নাইপার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। সোভিয়েতজুড়ে প্রায় দুই হাজার নারী স্নাইপার রেড আর্মিতে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে দেখা যায়, এই নারী স্নাইপারদের মধ্যে মাত্র ৫০০ জনই জীবিত রয়েছেন। লুডমিলা ছিলেন অদম্য। দিনের পর দিন শত্রুপক্ষ অধিকৃত অঞ্চলের কাছাকাছি স্নাইপিং পজিশনে কাটিয়ে দিতেন। এ সময় তার খাবার বলতে ছিল কেবল শুকনো রুটি এবং পানিÑকখনো কখনো তাও জুটত না। কিন্তু লুডমিলা যুদ্ধের নির্মম পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছিলেন।
১৯৪১ সালের অক্টোবরে জার্মানি-রোমানিয়ার সেনাবাহিনী ওডেসার নিয়ন্ত্রণ নিলে পাভলিচেঙ্কো ও তার ইউনিট সেভাস্তোপোলের দিকে সমুদ্রপথে অগ্রসর হয়। ঐতিহাসিক সেভাস্তোপোলের যুদ্ধেও লুডমিলা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। ১৯৪২ সালের মে মাস পর্যন্ত তার হাতে বধ হওয়া সৈনিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৭ জন। লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান লুডমিলা। জার্মানির সেনাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লিউডমিলা। প্রায়ই জার্মান রেডিও থেকে তাকে ভয়ংকরভাবে হত্যার হুমকি দিয়ে বার্তা প্রচার করা হতো।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে লিউডমিলা গুরুতর আহত হলে রণক্ষেত্র থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। ততদিনে লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। তাকে অর্ডার অব লেনিনে ভূষিত করে রেড আর্মির মেজর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। দেওয়া হয় রেড আর্মির স্নাইপিং ইনস্ট্রাক্টরের দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই রণক্ষেত্রে না যাওয়ার আদেশ মেনে নেওয়া একজন যোদ্ধার জন্য কষ্টের। লিউডমিলাও কষ্ট পেয়েছিলেন, তবুও আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নেওয়ার আগে লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো শত্রুপক্ষের ৩০৯ জন যোদ্ধাকে হত্যা করেন। তার মাঝে ৩৬ জন দক্ষ স্নাইপারও ছিলেন। তবে ধারণা করা হয়, লিউডমিলার হাতে ৫০০ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক শত্রুপক্ষের যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। শত্রু হত্যায় লিউডমিলার কাছাকাছি অবস্থান করছেন রেড আর্মির আরেক বিখ্যাত স্নাইপার ভ্যাসিলি জাইতসেভ। তার হাতে শত্রুপক্ষের ২২৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
যুদ্ধ চলাকালীন লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো এতটাই বিখ্যাত হয়েছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট তাকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানান। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে একই সঙ্গে যুদ্ধ করলেও আদর্শিক জায়গা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। কিন্তু লিউডমিলার বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তাকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। মার্কিন তরুণ-তরুণীদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহী করতেই মূলত লিউডমিলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রুজভেল্ট। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে লিউডমিলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩টি শহরে নাগরিকদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন তিনি। লিউডমিলাকে হোয়াইট হাউসে অভ্যর্থনা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ফার্স্ট লেডি এলেনরের সঙ্গে ডিনারেও অংশ নেন। লিউডমিলা ছিলেন প্রথম সোভিয়েত নাগরিক, যিনি হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে লিউডমিলা বহু জায়গায় মার্কিন পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক নানা তিক্ত মন্তব্যের শিকার হন। সফরকালে এক মার্কিন পুরুষ সাংবাদিক লিউডমিলার ভারি ইউনিফর্ম এবং তাতে ঝোলানো অসংখ্য মেডেল নিয়ে কটাক্ষের সুরে প্রশ্ন করেন। লিউডমিলা এ বিষয়ে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি আমার ইউনিফর্মটি সম্মানের জায়গা থেকে পরি। এর গায়ে ‘অর্ডার অব লেনিন’র মতো সম্মানজনক খেতাব জড়িয়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বয়ে যাওয়া পবিত্র রক্ত এই ইউনিফর্মে শোভা পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো সে দেশের মহিলারা তাদের ইউনিফর্মের নিচে সিল্কের অন্তর্বাস পরেন কি না। ইউনিফর্ম কী এবং তার গুরুত্ব তারা এখনো উপলব্ধি করতে শেখেনি।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পুনরায় কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করেন, সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন করেন। পাভলিচেঙ্কো একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দুইবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অর্ডার অব লেনিন লাভ করেন।
লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো তার আত্মজীবনী লিখে গেছেন। বইটির নাম ‘লেডি ডেথ : দ্য মেমোরিজ অব স্তালিন’জ স্নাইপার’। এটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলে। লিউডমিলাকে নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধ বিখ্যাত সংগীতশিল্পী উডি গুথরি ‘মিস পাভলিচেঙ্কো’ শিরোনামে একটি গান রচনা করেন। লিউডমিলার জীবনী অবলম্বনে ২০১৫ সালে নির্মিত হয় বায়োপিক ‘ব্যাটল ফর সেভাস্তোপোল’ নামের একটি সিনেমা, যা ব্যবসাসফল হয়।
১৯১৬ সালে বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দক্ষিণে বেলায়া সেরকভ শহরে লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোরে তিনি দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন বলে জানা যায়। ১৪ বছর বয়সে সপরিবারে কিয়েভে বসবাস করতে শুরু করেন তিনি। সে সময়ই শ্যুটিংয়ের হাতেখড়ি হয় তার। শ্যুটিংয়ে দক্ষতার জন্য ভেরোশিলভ শার্পশ্যুটার ব্যাজ এবং মার্কসম্যান সনদও পেয়েছিলেন লিউডমিলা। এই শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতাই একজন স্নাইপার হিসেবে রেড আর্মিতে তার যোগদানে সাহায্য করেছিল।
লিউডমিলা পাভলিচেঙ্কো ১৯৭৪ সালের ১০ অক্টোবর স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী পিটিএসডি (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার) ও হতাশায় ভুগছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তী অনেক যোদ্ধাই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, লিউডমিলাও হয়েছিলেন। যুদ্ধের বাস্তবতায় একজন আরেকজনকে আক্রোশে হত্যা করলেও একটা সময়ের পর সেই মৃত্যুগুলো মানুষকে কাঁদায়। তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। লিউডমিলার স্মরণে ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বিশেষ স্ট্যাম্প ইস্যু করে।