
গাজার পশ্চিমে আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে ভাইদের সঙ্গে দুই বছর বয়সী অপুষ্টিতে ভোগা ইয়াজান ছবি : এএফপি
আকরাম বশিরের সন্তানরা ক্ষুধায় কাঁদে। তাদের শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ‘এই অবরোধ একদিন শেষ হবে, তখন তোমরা যা খেতে চাও, খেতে পারবে।’ কিন্তু ৩৯ বছরের এই ফিলিস্তিনি বাবা জানেন, এ প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারবেন না। ‘আমার কিছু করার নেই’, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন বশির। ‘শুধু মানসিকভাবে সান্ত্বনা দিই। বলি, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে, খাবার আবার আসবে। আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’
গাজার মধ্যাঞ্চলীয় শহর দেইর আল-বালাহতে বাস করেন বশির। প্রতিদিন খাবারের খোঁজে ছুটে বেড়ান সন্তান ও বৃদ্ধ, অসুস্থ মা-বাবার জন্য। মার্চ মাস থেকে ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধে থাকা গাজার প্রায় ২১ লাখ মানুষের মতোই বশিরের পরিবারও আজ ক্ষুধায় বিপর্যস্ত। কখনো একবেলা খাবার জোটে, কিন্তু বেশির ভাগ দিনেই তা সম্ভব হয় না। বশির বলেন, “ক্ষুধায় আমার সন্তানদের চেহারা পাল্টে গেছে, ওরা ওজন হারাচ্ছে, সারা দিন ঘুমিয়ে কাটায়, মনোযোগ দিতে পারে না। সারাক্ষণ খাবার নিয়েই ভাবে, বিশেষ করে মিষ্টিজাতীয় কিছু। সব সময় বলে, ‘আমরা ক্ষুধার্ত’।” যেসব খাবার মেলে, তা প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেয় না। তিনি আরো বলেন, ‘ওদের পেট ভরে না। আমরাও ভালো নেই। সবাই ওজন হারিয়েছি। সামান্য কাজ করলেই শরীর ভেঙে পড়ে।’
দুর্ভিক্ষের প্রান্তে গাজা
গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, ২৬ জুলাই সেখানে ক্ষুধায় মারা গেছে পাঁচজন, যাদের মধ্যে দুজন শিশু। এখন পর্যন্ত গাজায় অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ১২৭ জনের, যার মধ্যে ৮৫ জন শিশু। সরকারি তথ্য বলছে, শিশুদের জন্য জরুরি ইনফ্যান্ট ফর্মুলা সরবরাহ না হলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এক লাখ শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে। গত ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সব সীমান্ত একেবারে সিল করে দিয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্য, পানি, ওষুধসহ সব ধরনের সহায়তা প্রবেশ।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা (আইপিসি) জানিয়েছে, মে মাসে গাজার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ ‘চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’র (আইপিসি পঞ্চম স্তর) মুখে পড়েছেন, যা বাস্তবিক অর্থেই দুর্ভিক্ষ। এরপর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে। এখন গাজার ২১ লাখ মানুষই এক বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। বশির বলছিলেন, ‘অবরোধ শুরু হয় রমজানের শুরুতে। তখন থেকেই সংকট তৈরি হয়। কিন্তু গত এক মাসে আমরা যা দেখছি, সেটা নজিরবিহীন। ঘরে যা কিছু ছিল, শেষ হয়ে গেছে। একসময় তো তা হবেই। ছোট ছোট সন্তানদের প্রতিদিন কিছু না কিছু খেতে হয়, অথচ আমরা কিছুই পাচ্ছি না।’
‘চার দিন শুধু লবণ-পানি খেয়েছি’
জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের ৩২ বছর বয়সী বাসিন্দা বাসেম মুনির আল-হিন্নাওয়ির অভিজ্ঞতাও একই রকম নির্মম। ‘গত এক মাসে আমরা চার-পাঁচ দিন পরপর একবার করে রুটি খেতে পেরেছি’ জানান তিনি। ‘রুটি না পেলে ছোট বিস্কুট কিনে দিই। যদি ডাল পাওয়া যায়, তা পাতলা করে রান্না করি।’ যুদ্ধের শুরুতেই বাবাকে হারিয়েছেন বাসেম। এখন তার কাঁধে দুটি পরিবারের দায়িত্ব-মা, দুই বোন, দুই ভাই, স্ত্রী এবং এক বছরের শিশুকন্যা।
অবরোধের প্রথম দিকে শুধু ক্ষুধা ছিল; এখন তার শারীরিক পরিণতিগুলো আরো ভয়ানক। বাসেম বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে আমার শরীর ভেঙে পড়েছে। ৩৯ কেজি ওজন কমেছে। আমার ভাই-বোনদের ওজনও ১৫ থেকে ২০ কেজি কমেছে। আমার বোন বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। স্ত্রীর অবস্থা আরো ভয়াবহ-সে এখনো বুকের দুধ খাওয়ায়, অথচ দুর্বলতায় এখন সামান্য কাজও করতে পারে না।’
যেটুকু খাবার মেলে, তা শুধু শিশুদের জন্য। বড়রা বেঁচে থাকে লবণ-গোলা পানি খেয়ে। বাসেম বলেন, ‘পাঁচবার সাহায্য নিতে গেছি, প্রতিবারই গুলির মুখে পড়েছি-ট্যাংক, ড্রোন থেকে গুলি চলেছে। একবারও খাবার পাইনি। এমন দিন গেছে, যখন টানা চার দিন আমরা কিছু না খেয়ে ছিলাম-শুধু লবণ-পানি খেয়ে বেঁচেছি।’
খাবারের সংকট এতটাই তীব্র যে, প্রতিদিন গাজার রাস্তায় রাস্তায় মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বাসেম আরো বলেন, ‘শেখ রাদওয়ানে, যেখানে আমি এখন আশ্রিত, গতকাল এক মহিলা হঠাৎ রাস্তায় পড়ে যান। পথচারীরা তাকে ফুটপাতে বসায়। পরে একজন এক চামচ চিনি এনে মুখে দেন। তাতেই তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পান।’ গাজায় এখন সেই চিনি-ই দুর্লভ।
চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয়
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি যুদ্ধ ও অবরোধের পর কমপক্ষে ১১৩ জন ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে ৮১ জন শিশু, ক্ষুধায় মারা গেছে। অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৮ হাজার, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে। গত ২৩ জুলাই শতাধিক মানবিক সংস্থা সতর্ক করেছে, মার্চের শুরুতে ইসরায়েল মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা দেওয়ার পর গাজা উপত্যকায় ‘ব্যাপক দুর্ভিক্ষ’ ছড়িয়ে পড়ছে এবং মে মাসের শেষ থেকে বিতর্কিত জিএইচএফের মাধ্যমে অত্যন্ত অপর্যাপ্ত সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যালেক্স ডি ওয়াল ইসরায়েলকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ‘গণহত্যামূলক অনাহার’-এর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। এই বাস্তবতায় ফিলিস্তিনি মা-বাবারা অসহায়।
গাজার রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির-সবখানে এখন একই দৃশ্য-ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তনাদ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষ আর শূন্য বাজার। এই মুহূর্তে বিশ্ব যদি নীরব থাকে, তাহলে এই এক লাখ শিশু শুধু সংখ্যা হয়েই থেকে যাবে মৃত্যুর তালিকায়।