
থাইল্যান্ডের সিসাকেত প্রদেশে কম্বোডিয়া সীমান্তে থাই সামরিক বাহিনীর যান ছবি : রয়টার্স
রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া ‘তাৎক্ষণিক’ ও ‘নিঃশর্ত’ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম। তার মধ্যস্থতায় ২৮ জুলাই মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় এক বৈঠকে এ ব্যাপারে সমঝোতায় আসে দেশ দুটি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অংশ নেন থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই ও কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত। বৈঠক শেষে আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৮ জুলাই মধ্যরাত থেকে এই যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। এটি উত্তেজনা প্রশমনের দিকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম পদক্ষেপ। আমরা ইতিবাচক অগ্রগতি দেখছি, যা শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথ প্রশস্ত করবে।’
বৈঠক শেষে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত বলেন, ‘থাইল্যান্ডের সঙ্গে যে শর্তহীন যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছে, তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।’ বৈঠকের আগে হুন মানেত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন, আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা।
যুদ্ধবিরতির এই উদ্যোগ এমন সময়ে এলো যখন যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট বার্তা দেন, যদি দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যেতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই আগে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে। শুরুতে থাইল্যান্ড সীমান্ত সমস্যায় তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা মেনে নিতে চায়নি। তবে ট্রাম্পের এই অবস্থানের পর দেশটি
তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা মেনে আলোচনায় বসতে রাজি হয়। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া-উভয়ের সঙ্গেই চীনের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। তবে কম্বোডিয়ার সঙ্গে তুলনামূলক ঘনিষ্ঠ বেইজিং।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩৫ জন ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার দুই লাখ ৭০ হাজার মানুষ। হতাহত ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা থাইল্যান্ড সীমান্তে বেশি হয়েছে।
যে কারণে এই সংঘাত
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হলো একাদশ শতকের প্রাচীন হিন্দু মন্দির ‘তা মুএন থম’। কেন এই মন্দিরকে ঘিরে আবার জেগে উঠেছে পুরোনো সংঘর্ষ, তা নিয়ে ২৫ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। এই মন্দির ও আশপাশের আরো কিছু ধর্মীয় স্থাপনা নিয়েই কয়েক দশক ধরে চলেছে তাদের বিরোধ।
সীমান্তবর্তী এই এলাকায় খেমার সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রিঅ্যাহ বিহেয়ার মন্দির, যা শিবের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত এবং কম্বোডিয়ার ডাংরেক পাহাড়ে অবস্থিত। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এক রায়ে প্রিঅ্যাহ বিহেয়ার মন্দির ও তার আশপাশের অঞ্চল কম্বোডিয়ার অংশ বলে ঘোষণা দেয়। থাইল্যান্ড তখন রায় মানলেও সীমান্ত নিয়ে বিরোধ কমেনি। ২০১৩ সালে আদালত ফের রায় ব্যাখ্যা করে জানায়, মন্দিরের চারপাশের ভূখণ্ডও কম্বোডিয়ার সার্বভৌমত্বের আওতায় এবং থাইল্যান্ডকে সেখান থেকেও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
‘তা মুএন থম’ কেন নতুন সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তে নতুন সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘তা মুএন থম’ মন্দির, যার পেছনে রয়েছে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নানা জটিলতা। খেমার সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত এই হিন্দু মন্দিরটি দেবতা শিবকে উৎসর্গীকৃত এবং এর গর্ভগৃহে একটি প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ এখনো পূজিত হয়। থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশ থেকে প্রবেশযোগ্য হলেও কম্বোডিয়া দাবি করে এটি তাদের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। মন্দিরটি সীমান্তের দুর্গম বনাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পষ্ট সীমারেখার অভাবে উভয় দেশই এটিকে নিজেদের দাবি করে আসছে। সম্প্রতি মন্দির এলাকায় কম্বোডীয় সেনাদের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে, যার ভিডিও পরবর্তী সময়ে সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক আদালত প্রিঅ্যাহ বিহেয়ার মন্দির নিয়ে রায় দিলেও তা মুএন থম নিয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত না থাকায় এটি এক ধরনের ‘গ্রে এরিয়া’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে ধর্ম, জাতীয়তা ও ভূখণ্ডের প্রশ্নে প্রতীকী ও বাস্তব বিরোধ মিলিয়ে এই মন্দির এখন দুই দেশের সংঘাতের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
ফরাসি মানচিত্র ও বর্তমান সীমানা বিতর্ক
এই বিরোধের শিকড় আরো পুরোনো। ১৯০৪ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে ফ্রান্স ও সিয়ামের (বর্তমান থাইল্যান্ড) মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে যে মানচিত্র তৈরি হয়েছিল, সেটি অনুযায়ী প্রিঅ্যাহ বিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
তবে থাইল্যান্ড দাবি করে, তারা ভুলবশত সে মানচিত্র মেনে নিয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সীমান্তটি জলবিভাজিকা অনুসারে নির্ধারিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালত এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৮ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় প্রিঅ্যাহ বিহেয়ারকে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েও ব্যাপক রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং সে বছরই নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়।