টার্কি টেকনিকে ধর্ষক প্রমাণিত হলেন দেবেগৌড়ার নাতি

মো. ইমরানুর রহমান
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৫১

প্রজ্জল রেভান্না
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের এক আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার নাতি প্রজ্বল রেভান্নাকে তার গৃহকর্মীকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। ২ আগস্ট এই রায় ঘোষণা করা হয়। এর এক দিন আগেই ৩৪ বছর বয়সী সাবেক এই এমপিকে যৌন নির্যাতনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন বিচারক।
২০২৩ সালে প্রথম এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে, যখন রেভান্নার শত শত অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। রেভান্না অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। ১ আগস্ট আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে লঘু দণ্ডের জন্য আবেদন করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করতে পারবেন।
রেভান্নার পরিবার ভারতের জনতা দল (সেক্যুলার) দলের নেতৃত্বে রয়েছে, যারা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপির সঙ্গে জোটে আছে। ভারতে এমন প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের কারো বিরুদ্ধে এমন কঠোর সাজা খুবই বিরল।
২০২৪ সালের এপ্রিলে ভিডিও কেলেঙ্কারি ছড়িয়ে পড়ার পর রেভান্না কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ ছাড়েন। তখন তিনি ভিডিও নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, ভিডিওগুলো নকল বা সম্পাদিত। পরে জার্মানি থেকে দেশে ফেরার পর মে মাসে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রেভান্নার বিরুদ্ধে এখনো আরো দুটি ধর্ষণ মামলা এবং একটি যৌন হয়রানির মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সব অভিযোগই তিনি অস্বীকার করেছেন। যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ ভিডিওতে নিজের মুখ বা কণ্ঠস্বর প্রকাশ না করে অপরাধ লুকানোর জন্য সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন সাবেক এমপি রেভান্না। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বিশেষ তদন্তদল এসআইটি তার পরিচয় নিশ্চিত করতে যে অভিনব কৌশল ব্যবহার করেছে, তা ভারতীয় অপরাধ তদন্তের ইতিহাসে প্রথম, যাকে বলা হচ্ছে ‘টার্কি টেকনিক’।
‘টার্কি টেকনিক’ কী?
‘টার্কি টেকনিক’ হলো ফরেনসিক চিহ্ন মিলিয়ে অপরাধীর পরিচয় শনাক্ত করার এক বিশেষ ধরনের প্রক্রিয়া, যার উৎপত্তি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। মূলত শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা ভিডিও ধারণের সময় নিজেদের মুখ ঢেকে রাখতেন। এমনকি কণ্ঠস্বরও বিকৃত করে উপস্থাপন করতেন। ফলে তাদের শনাক্ত করা ও আদালতে প্রমাণ হাজির করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে পর্নোগ্রাফি মামলায় অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এক নতুন ও বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটায়। সেটিকেই বলা হচ্ছে টার্কি টেকনিক।
এই পদ্ধতিতে যদি কারো দেহের কোনো নির্দিষ্ট অংশের (যেমন-আঙুল, পা, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি) ছবি বা ভিডিওর প্রমাণ থাকে, তবে সেটি অভিযুক্ত ব্যক্তির দেহের একই অংশের বর্তমান ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। লক্ষ্য থাকে-চামড়ার দাগ, তিল, আঙুলের বাঁক, হাড়ের গঠন বা অন্যান্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
রেভান্নার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রয়োগ হলো
রেভান্নার যৌন নির্যাতনের ভিডিওতে সাধারণত তিনি মুখ ঢেকে রাখতেন। কণ্ঠস্বর চাপা স্বরে রাখতেন। কিন্তু ভিডিওতে তার শরীরের কিছু অংশ-যেমন আঙুল, তালু, গোড়ালি, পায়ের গঠন ও যৌনাঙ্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এরপর এসআইটি ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট সংগ্রহ করে। রেভান্নাকে একই ভঙ্গিমায় তার দেহের ওই অংশগুলো দেখাতে বলা হয়। ছবি তুলে সেগুলোর সঙ্গে ভিডিওর অংশ মিলিয়ে দেখা হয়, যেমন-আঙুলের বাঁক, পায়ের গঠন, তিল বা দাগের অবস্থান ইত্যাদি। এরপর চর্মরোগ, অস্থি ও মূত্রবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ফরেনসিক দল সিদ্ধান্তে আসে যে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি রেভান্নাই।
ভারতের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর আইন্ডেটিফিকেশন অ্যাক্ট ২০২২ অনুযায়ী, তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিভিন্ন শারীরিক মাপ ও বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করার অধিকার আছে। সেই আইনের আওতায় এই ‘টার্কি টেকনিক’ প্রয়োগ করা হয়। এই বৈজ্ঞানিক প্রমাণসহ অন্যান্য মেডিক্যাল ও ডিজিটাল সাক্ষ্য আদালতে পেশ করে এসআইটি। কর্ণাটকের আদালত আইপিসির ৩৭৬(২)(এন) ধারায় রেভান্নাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ লাখ রুপি জরিমানা করেন।
সংক্ষেপে, মুখ না দেখা গেলেও শরীর বলে দেয় অপরাধী কে। ‘টার্কি টেকনিক’ হয়ে উঠেছে এমন অপরাধে অপরাধী শনাক্তের এক নিখুঁত বৈজ্ঞানিক অস্ত্র।