Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পের নতুন শুল্কচালে বিভক্ত বিশ্ব

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৫৬

ট্রাম্পের নতুন শুল্কচালে বিভক্ত বিশ্ব

ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত নতুন শুল্কহার বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। এই শুল্কের জেরে দেশগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া এতটাই ভিন্ন যে, মনে হচ্ছে যেন বিশ্ববাণিজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে আছে হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের দল, অন্যদিকে রয়েছে স্বস্তি ও আপসের কৌশল খুঁজে পাওয়া দেশগুলো। এই বিভাজনের কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিটি দেশের দর-কষাকষির সক্ষমতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে কৌশলগত গুরুত্ব প্রমাণের এক কঠিন পরীক্ষা। 

এই শুল্কের সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে কানাডার মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্ররা। ২৫ শতাংশ থেকে শুল্ক বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত কানাডার জন্য একটি বড় ধাক্কা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির হতাশা প্রকাশ মূলত এই বাস্তবতারই প্রতিফলন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক মিত্রতার সম্পর্কও এমন একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারছে না। আরো বড় ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছে সুইজারল্যান্ড। তাদের ওপর প্রাথমিক প্রস্তাবের চেয়েও বেশি, অর্থাৎ ৩১ শতাংশের বদলে ৩৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সুইস সরকারের বিবৃতিতে যে গভীর দুঃখ ও হতাশার কথা বলা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে আলোচনার টেবিলে গঠনমূলক অবস্থান নেওয়ার পরেও শেষ মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্তের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। এটি প্রমাণ করে ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি কতটা ব্যক্তিগত এবং অনিশ্চিত, যেখানে দীর্ঘদিনের মিত্ররাও অপ্রত্যাশিত শাস্তির শিকার হতে পারে। 

অন্যদিকে কিছু দেশ প্রাথমিক বিপর্যয় এড়াতে পারলেও পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়ের মতো দেশগুলো ১৫ শতাংশ বা তার কাছাকাছি শুল্কহারকে অযৌক্তিক মনে করছে এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়তো তারা সহ্য করতে পারত, কিন্তু এর বেশি বৃদ্ধি তাদের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য মারাত্মক। অস্ট্রেলিয়ার পরিস্থিতি আরো জটিল। তাদের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আগে থেকেই ৫০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এই দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তারা সহজে হার মানতে রাজি নয়, তবে দর-কষাকষির পথ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। 

জাপানের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তি ১৫ শতাংশ হারে কিছুটা স্বস্তি পেলেও তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তাদের মূল চিন্তা গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের বাজার নিয়ে, যা জাপানের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাইওয়ানের পরিস্থিতি আরো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেমিকন্ডাক্টরের প্রধান সরবরাহকারী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ৩২ শতাংশের প্রস্তাবিত শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে এনেছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তারা তাদের প্রযুক্তিগত গুরুত্বকে একটি দর-কষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরো ভালো কোনো চুক্তির আশা করছে। 

তবে এই বাণিজ্য নাটকে সবচেয়ে চমক দেখিয়েছে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। এপ্রিলের প্রস্তাবে কম্বোডিয়ার ওপর বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা এখন মাত্র ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও বাংলাদেশও বড় ধরনের ছাড় পেয়েছে। এই দেশগুলোর স্বস্তি প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য, যার অর্থনীতি পোশাকশিল্পের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ৩৫ শতাংশের প্রস্তাবিত শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসা নিঃসন্দেহে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত করেছে। কিন্তু এই স্বস্তির পেছনে রয়েছে বড় ধরনের কৌশলগত আপস। কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডকে সীমান্তে অস্ত্রবিরতি চুক্তি করতে হয়েছে। কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১০টি বোয়িং বিমান কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বাংলাদেশও মার্কিন কৃষি পণ্য কেনার আশ্বাস দিয়েছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন একটি বার্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে; তারাই বাণিজ্য ক্ষেত্রে ছাড় পাবে। এটি এক ধরনের ‘লেনদেনের কূটনীতি’, যেখানে শুল্ককে ব্যবহার করে অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন করা হচ্ছে। 

এই পুরো ঘটনার পটভূমিতে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার নাম চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় একটি থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে উচ্চ শুল্ক আরোপ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল এবং আর্থিক বাজারের জন্য এক অশনিসংকেত। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের এই নতুন শুল্কনীতি একটি খণ্ডিত ও অনিশ্চিত বিশ্বব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে। এখানে পারস্পরিক মিত্রতার চেয়ে লেনদেনের সম্পর্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং প্রতিটি দেশকেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত এক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। এই শুল্কের খেলা বিশ্ব অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা সময়ই বলে দেবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫