Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলের গাজা দখল পরিকল্পনা ও পশ্চিমা দায়মুক্তি

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৭:১৩

ইসরায়েলের গাজা দখল পরিকল্পনা ও পশ্চিমা দায়মুক্তি

লাশের মিছিল বাড়ছে গাজায় ছবি : এএফপি

ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা ৮ আগস্ট গাজায় পাঁচটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রশাসনের দেওয়া বিবৃতি অনুযায়ী লক্ষ্যগুলো হলো-হামাসকে নিরস্ত্র করা, সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা, গাজা উপত্যকার সামরিকীকরণ বিলোপ, উপত্যকায় ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে ‘বিকল্প বেসামরিক প্রশাসন’ প্রতিষ্ঠা করা।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজা সিটির ‘নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত’। কিন্তু অতীতে একাধিক অভিযান চালানোর পরও হামাস পুনর্গঠিত হয়ে ফিরে এসেছে। নতুন কোনো স্থল অভিযান আবারও হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে, খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে।

বিক্ষোভ ও জিম্মি ইস্যু

জায়নবাদী দখলদারদের নতুন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ইসরায়েলজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। গাজায় বন্দি ৫০ জন জিম্মির মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা মনে করছে, দখল পরিকল্পনা জিম্মিদের জীবনকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। জেরুজালেমে এক সাবেক সেনা সদস্য বলেন, ‘আমরা ৩৫০ জনেরও বেশি সৈন্য, যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি, এখন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করছি।’

প্রসঙ্গত, যখন আরব রাজতান্ত্রিক শাসকদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নীলনকশায় গোটা ফিলিস্তিন ইসরায়েলের দখলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল-যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের নামটাই মুছে ফেলা; আর ‘আব্রাহাম চুক্তি’র মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রকাশ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন শুরু হয়; ঠিক সেই সময়েই বিশ্বের সর্ববৃহৎ কারাগারখ্যাত গাজা থেকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে হামলা চালায় হামাস। ওই হামলায় ইসরায়েলের এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পরপরই গাজায় সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। প্রায় দুই বছরে গাজায় নিহত হয়েছে অন্তত ৬১ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি, বাস্তুচ্যুত পুরো উপত্যকার মানুষ।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় নেতানিয়াহুর পরিকল্পনাকে ‘গণহত্যা, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও অবরোধের ধারাবাহিকতা’ আখ্যা দিয়েছে। হামাসও হুঁশিয়ারি দিয়েছে-গাজা দখলের চেষ্টা হলে সব জিম্মি হারাতে হবে ইসরায়েলকে। জাতিসংঘ, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীনসহ বহু দেশ ইসরায়েলের পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। জার্মানি ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের পরিপন্থি।

প্রতীকী স্বীকৃতির আড়ালে ফাঁপা কূটনীতি

গাজার ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির প্রতীকী পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে কিছু পশ্চিমা দেশ। ফ্রান্স ও সৌদি আরব জাতিসংঘের ব্যানারে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার দিয়েছেন শর্তসাপেক্ষে স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি, যা অনেকের কাছে রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। এই স্বীকৃতি প্রকৃত সার্বভৌমত্ব নয়-বরং এক নিরস্ত্র, খণ্ডিত ভূখণ্ড, যার সীমান্ত, আকাশসীমা ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের। এটি হবে এক ‘ভূত প্রশাসন’-অসলো চুক্তির চেয়েও সীমিত, মুক্তির আবরণে সাজানো এক প্রহসন।

এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্স আরব ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে হারানো প্রভাব পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে, যদিও একসময় ইসরায়েলের পারমাণবিক সক্ষমতায় সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল দেশটি। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যৌক্তিকতা তৈরিতে সৌদি আরব এই স্বীকৃতিকে ব্যবহার করছে-আব্রাহাম চুক্তির জাল আরো বিস্তারের লক্ষ্যে। আর স্টারমার গাজা ইস্যুতে জনরোষ থেকে নজর সরাতে এই ঘোষণা ব্যবহার করছেন।

এই স্বীকৃতির উদ্যোগ আসলে ইসরায়েলকে তথাকথিত ‘শান্তি প্রক্রিয়া’য় ফেরানোর হাতিয়ার, যেখানে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হবে দরকষাকষির তাস, মৌলিক অধিকার নয়।

পশ্চিম তীরে দখলদার বসতি সংখ্যা ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর দ্বিগুণ হয়ে সাত লাখ ছাড়িয়েছে। প্রতিশ্রুত বসতি স্থাপন বন্ধের পরিবর্তে দখলদারিত্ব বেড়েছে। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রতিস্থাপন করেছে অবিরাম আলোচনা ও বিলম্ব কৌশল। এটাই ইসরায়েল প্রশ্নে পশ্চিমা কূটনীতি-পররাষ্ট্রনীতি।

কাগুজে রাষ্ট্র

পশ্চিমা রাজনীতিতে ফিলিস্তিনের কোনো প্রতীকী পদক্ষেপও তেল আবিবের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। অথচ দখলদার ইসরায়েলি জোট এমনকি এই ফাঁপা স্বীকৃতিতেও ক্ষুব্ধ। বাস্তবতা হলো, গাজা মুছে ফেলা হচ্ছে। ইসরায়েলি মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বলছেন, ‘গাজার সব হবে ইহুদিদের’ এবং ‘আমাদের এমন কষ্ট দিতে হবে, যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর’।

আজও ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি। রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা চলছে অব্যাহতভাবে-ফিলিস্তিনিদের জীবনের অধিকারকে আড়াল করে। সেই সঙ্গে চলছে অর্থ আর মিথ্যার সরবরাহ। যদি সত্যিই এই পশ্চিমা দেশগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে বিশ্বাসী হতো, তবে প্রথম পদক্ষেপ হতো ইসরায়েলে সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা বন্ধ করা। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যেভাবে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির কথা বলছে, তা গণহত্যা থামানোর জন্য নয়; বরং রাজনৈতিক দায়মুক্তির পথ তৈরি করার জন্য। পদক্ষেপহীন স্বীকৃতি শুধু অর্থহীনই নয়; বরং হত্যাযজ্ঞের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫