সংবাদকর্মীদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েল

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৭:১৩

সাংবাদিক আহমেদ আল লও গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন ছবি : রয়টার্স
ইসরায়েল এখন গাজার কণ্ঠ রোধ করতে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। নিয়মিতভাবে সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই-তারা যেন জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে এই কাজ থেকে সরে দাঁড়ান। আলজাজিরার প্রতিবেদক হানি আল-শায়ের বলেন, গত ১০ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে সাংবাদিকদের জন্য বসানো তাঁবুতে একটি ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালায়। মোট সাতজন এ হামলায় নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ (২৮) এবং তার তিন সহকর্মী : সংবাদদাতা মোহাম্মদ কুরেইকেহ (৩৩), ক্যামেরাপারসন ইব্রাহিম জাহের (২৫) এবং মোহাম্মদ নওফেল (২৯)। এটাই প্রথমবার নয় যে আলজাজিরার সাংবাদিকদের ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এর আগে আলজাজিরার অন্তত পাঁচ সাংবাদিক ইসরায়েলের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর, আলজাজিরার ক্যামেরাপারসন সামির আবুদাকা গাজায় আলজাজিরার ব্যুরো-প্রধান ওয়ায়েল দাহদুহর সঙ্গে কাজ করার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হন। ওয়ায়েল আহত হলেও আবুদাকাকে খান ইউনিসের ফারহানা স্কুলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। ইসরায়েলি সেনারা উদ্ধারকর্মীদের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বাধা দেওয়ায় তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। গত বছরের ৭ জানুয়ারি ওয়ায়েলের বড় ছেলে এবং আলজাজিরার সাংবাদিক হামজা দাহদুহ খান ইউনিসে যাতায়াতের সময় তার গাড়িতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন। একই বছরের ৩১ জুলাই, শাতি শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন সাংবাদিক ইসমাইল আল-ঘৌল এবং তার ক্যামেরাপারসন রামি আল-রিফি। যদিও তাদের গাড়িতে স্পষ্টভাবে ‘মিডিয়া’ লেখা ছিল এবং দুজনই সাংবাদিক পরিচয়বাহী ভেস্ট পরেছিলেন।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রকল্প জানাচ্ছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ এবং ৯/১১-পরবর্তী আফগানিস্তান যুদ্ধ মিলিয়েও যত সাংবাদিক নিহত হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল ছিল সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর; যেখানে ১২০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হন। শুধু ওই বছরেই গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫০ জনের বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি অজুহাত
সাংবাদিক হত্যার জন্য সেই একই পুরোনো সাফাই গেয়ে চলেছে ইসরায়েলি প্রশাসন। নিহত সাংবাদিকদের ‘হামাস সদস্য’ বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। অথচ এ দাবির পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল সাংবাদিক হত্যার ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে ‘হামাস সদস্য হওয়ার অভিযোগ’কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসও (সিপিজে) ইসরায়েলি এমন কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক সারা কুদাহ বলেন, ‘আনাসের বিরুদ্ধে হামাসের সদস্য হওয়ার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।
যুদ্ধের শুরু থেকেই আলজাজিরার সাংবাদিক হিসেবে অনেক সাহসী কাজ তিনি করে আসছিলেন। যখনই যুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শক্তিশালী কোনো প্রতিবেদন তিনি তৈরি করেছেন, তখনই এ ধরনের অপবাদ দেওয়া হতো। ত্রাণ প্রবেশে ইসরায়েলি বাধার কারণে উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি নিয়ে তার প্রতিবেদনটি এ ধরনের অপবাদের সবশেষ উদাহরণ। আর শুধু আনাস একা নন, অনেকেই এভাবে লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন।’ আনাস গত বছর মানবাধিকার রক্ষার জন্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
প্রতি মাসে নিহত ১৩ সাংবাদিক
গাজায় গত ২২ মাসে অন্তত ২৭০ সংবাদমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আলজাজিরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধি নিয়মিতভাবে টার্গেট হচ্ছেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে ১৩ জন। এ হিসাব দিয়েছে শিরীন ডট পিএস নামের একটি পর্যবেক্ষণ সংস্থা, যা ২০২২ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত আলজাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত।
এ বছরের জুনে আরএসএফ, সিপিজে ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যৌথভাবে এক খোলা চিঠিতে জানিয়েছিল, বাইরের সাংবাদিকরা যাদের ওপর নির্ভর করেছেন, সেই গাজার সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত প্রাণের ঝুঁকিতে থেকে কাজ করছেন।
সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা যুদ্ধাপরাধ
আলজাজিরা তাদের সাংবাদিকদের হত্যাকে ‘মিডিয়ার স্বাধীনতার ওপর আরেকটি নগ্ন ও পরিকল্পিত আঘাত’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, আনাস ও তার সহকর্মীরা গাজার ভেতরে বাকি থাকা শেষ কয়েকটি কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধি ছিলেন,যাদের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে যুদ্ধের বাস্তবতা জানাচ্ছিল; যেখানে ইসরায়েল বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে গাজায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি মিশন ইসরায়েলকে ‘আল-শরিফ ও কুরেইকেহকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার’ অভিযোগ করেছে, কারণ তারা ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের গণহত্যা ও ক্ষুধাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নীতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সাংবাদিকদের অবশ্যই ভয়ভীতি ছাড়াই কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ আখ্যা দিয়ে আনাসকে ‘সাহসী ও অসাধারণ সাংবাদিক’ হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েল কেবল সাংবাদিকদের হত্যা করছে না, সাংবাদিকতাকেই আক্রমণ করছে গণহত্যার নথিপত্র ঠেকাতে।’ আন্তর্জাতিক পরিসরে তীব্র নিন্দা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে দখলদার বাহিনী।