
খাবারের জন্য হাহাকার গাজাবাসীর
কয়েক মাস ধরেই গাজা ভয়াবহ খাদ্যসংকটে ভুগছিল। তবে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে গঠিত একটি বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা গাজার কেন্দ্র ও অবরুদ্ধ উপকূলীয় অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্ভিক্ষ’ ঘোষণা করেছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) অনুসারে, দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয় তখনই, যখন খাদ্যাভাব চরম মাত্রায় পৌঁছায়। এর জন্য তিনটি নির্দিষ্ট সূচকে সীমা অতিক্রম করতে হয়-চরম খাদ্যাভাব, তীব্র অপুষ্টি এবং অনাহারজনিত মৃত্যু। এর মানে দাঁড়ায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পর গাজায় এ পর্যন্ত যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, আইপিসি হলো জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), ইউনিসেফ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ (ডব্লিউএফপি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটি যৌথ উদ্যোগ।
২২ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে তারা জানায়, ১৫ আগস্ট থেকে গাজা গভর্নরেট-যেখানে গাজা সিটি অবস্থিত ‘সম্পূর্ণ মানুষসৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষের মধ্যে রয়েছে, এমন ‘যৌক্তিক প্রমাণ’ পাওয়া গেছে। আইপিসি দুর্ভিক্ষকে খাদ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে ভয়াবহ ধাপ বা ফেজ-৫ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। ফেজ-১ নির্দেশ করে, কোনো সমস্যা নেই বা সামান্য খাদ্যাভাব। ফেজ-২ থেকে ৪ পর্যন্ত ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে খাদ্যসংকট ও অপুষ্টির মাত্রা। আর ফেজ-৫ মানে হলো মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে, সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করেও মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। যদি কোনো এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ এই অবস্থায় পৌঁছে যায় এবং সেখানে চরম অপুষ্টি ও মৃত্যু দেখা দেয়, তখনই সেই অঞ্চলকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্ভিক্ষগ্রস্ত’ ঘোষণা করা হয়।
ইসরায়েল বরাবরের মতোই সব প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, তথ্যগুলো হামাস সরবরাহ করেছে। তবে ২০১১ সাল থেকে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার ঘটনা মাত্র কয়েকবার ঘটেছেÑসোমালিয়া (২০১১), দক্ষিণ সুদান (২০১৭, ২০২০) ও সুদান (২০২৪)। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো গাজার নাম।
সংখ্যার বিচারে পরিস্থিতি
১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত গাজা, দেইর আল-বালাহ এবং খান ইউনিস গভর্নরেটের প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার মানুষই অন্তত ফেজ-৩ মাত্রার খাদ্যসংকটে ছিলেন। মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে চরম অনাহারে থাকা পরিবারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এ তিনটি গভর্নরেটের মধ্যে পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৭২০ জন ‘বিপর্যয়কর’ বা ফেজ-৫ মাত্রার খাদ্যসংকটে পড়েছে। ১৬ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই তিন অঞ্চলই দুর্ভিক্ষগ্রস্ত থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তখন প্রায় ছয় লাখ ৪০ হাজার মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ চরম অনাহারে থাকবে। উত্তর গাজার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য না থাকলেও আইপিসি মনে করে, সেখানকার অবস্থা অন্তত গাজা সিটির মতোই ভয়াবহ নয়, যদি না আরো খারাপ পরিস্থিতি সামনে আসে।
বর্তমানে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯০ শতাংশ দিনে দুই বেলা খাবার পাচ্ছে না। আইপিসি চারটি প্রধান কারণকে দায়ী করেছে এই বিপর্যয়ের জন্য-
১. ক্রমাগত সংঘাত : যাতে ৬২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং দেড় লাখের বেশি আহত।
২. অবিরাম বাস্তুচ্যুতি : এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বারবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে; ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা সামরিকায়িত বা উচ্ছেদের আওতায়।
৩. মানবিক ও বাণিজ্যিক সরবরাহ বন্ধ : মার্চের মাঝামাঝি থেকে খাবার, পানি, ওষুধ, আশ্রয় ও জ্বালানি প্রবেশ প্রায় বন্ধ।
৪. খাদ্যব্যবস্থার পতন : ৯৮ শতাংশ আবাদি জমি নষ্ট বা অগম্য, গবাদিপশু প্রায় নেই, মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
জাতিসংঘ : মানবতার ব্যর্থতা
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক কু দংইউ বলেন, ‘গাজার মানুষ টিকে থাকার সব পথ শেষ করে ফেলেছে। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নিরাপদ ও স্থায়ীভাবে বৃহৎ আকারে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। খাদ্য পাওয়া কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার।’
আইপিসিও বলেছে, যেহেতু দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি মানবসৃষ্ট, তাই তা থামানো ও উল্টানো সম্ভব।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে আখ্যা দিয়েছেন ‘মানবতার ব্যর্থতা’ হিসেবে। তিনি আবারও ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি এক্সে লিখেছেন, ‘এটি পরিকল্পিত অনাহার এবং ইসরায়েল সরকারের সৃষ্ট। কয়েক মাস ধরে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস এমনকি ইউএনআরডব্লিউএর জিনিস প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।’ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সাহায্য প্রবেশের সুযোগই কেবল দুর্ভিক্ষের বিস্তার ঠেকাতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
খাবারের খোঁজে নিহত মানুষ
খাবার জোগাড় করতে যাওয়া মানুষদেরও ইসরায়েলি বাহিনী আক্রমণ করছে। শিশুদের গুলি করার ঘটনাও নথিভুক্ত হয়েছে। ২৭ জুলাই দুই কিশোরকে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। ১৫ বছরের মোহাম্মদ আল-হুইতি বলেন, ‘গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দৌড়ে যাই। হঠাৎ পাঁচটি ট্যাংক এসে আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে। অসংখ্য শহীদ ও আহত হয়। আমার মাথায় শেল ঢুকে আছে, এখনো তীব্র ব্যথা পাই। অথচ আমি শুধু খাবারের জন্য গিয়েছিলাম।’
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, ২৭ মে থেকে ১ আগস্টের মধ্যে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত এক হাজার ৩৭৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই ইসরায়েলি সেনারা হত্যা করেছে।
নারী, শিশু ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপর্যয়
প্রায় ৫৫ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছেন। পানির সংকট ভয়াবহ-৯৬ শতাংশ পরিবার মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার পানিসংকটে আক্রান্ত। ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র অর্ধেক আংশিক চালু, কোনোটি পূর্ণভাবে সচল নয়। টিকাদান ও পুষ্টিসেবা কার্যক্রম ভেঙে পড়ায় শিশু ও নারীরা রোগ, অপুষ্টি ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ঝুঁকিতে। জুলাইয়ে ৪৩ শতাংশ শিশু ডায়রিয়ায়, ৫৮ শতাংশ জ্বরে, ২৫ শতাংশ শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমিত এবং প্রায় অর্ধেক শিশু চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে।