ট্রাম্পের শুল্কে কাবু হয়ে চীনের দ্বারস্থ মোদি

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৮

প্রতীকী ছবি
গেল সপ্তাহে রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখার অভিযোগে হীরা ও চিংড়ির মতো ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সিদ্ধান্তের তীব্র অভিঘাতে আহত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বেইজিংয়ের পথে যাত্রা করেন, তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে এক নতুন এবং সম্ভবত অভাবনীয় অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। পুরোনো বৈরিতা ও সীমান্ত সংঘাতের তিক্ত স্মৃতিকে পাশে রেখে চীনের মাটিতে মোদির পদার্পণ কেবল একটি কূটনৈতিক সফর নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত বাধ্যবাধকতা এবং বিশ্ববাণিজ্যের গতিপথ পরিবর্তনের এক জোরালো ইঙ্গিত।
মোদির এই সফরের আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ্য সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন। চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত এই আঞ্চলিক জোটকে দীর্ঘকাল ধরেই পশ্চিমাদের বিকল্প একটি শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। অতীতে ভারত এসসিওকে তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে না রাখলেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের নাটকীয় অবনতির পর নয়াদিল্লি এখন এই জোটের কার্যকারিতা নতুন করে উপলব্ধি করছে। এই পরিবর্তিত
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এসসিও সম্মেলনটি ভারত ও চীনের জন্য শুধু আলোচনা সভাই নয়, বরং ওয়াশিংটনের প্রতি একটি সম্মিলিত বার্তা প্রেরণের মঞ্চও বটে।
বেইজিংভিত্তিক উসাওয়া অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা কিয়ান লিউ বলেন, ‘বিশ্ব এতদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। এখন সময় এসেছে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং সম্ভাব্য তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ও ভারত কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেদিকে আরো মনোযোগ দেওয়ার।’ এই পর্যবেক্ষণটি বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। একদিকে মার্কিন শুল্কের আঘাতে ভারতের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও তার দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশচুম্বী শুল্ক বেইজিংয়ের পরিকল্পনাকেও বিপর্যস্ত করার হুমকি দিচ্ছে। এই অভিন্ন সংকটই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশকে এক নতুন পথের সন্ধানে নামিয়েছে, যেখানে দশকের পর দশক ধরে সীমান্ত বিরোধ এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসই ছিল সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
কিন্তু এই সম্পর্কের পথটি অত্যন্ত জটিল ও কাঁটাযুক্ত। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত বিরোধ এক গভীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতীক। ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের জন্ম দেয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে। সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ভিসা প্রদান এবং চীনা বিনিয়োগ স্থগিত করা হয়, যা ভারতের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে ধীর করে দেয়। এর পাশাপাশি ভারত টিকটকসহ ২০০টিরও বেশি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে প্রযুক্তি খাতেও কঠোর অবস্থান নেয়।
ঐতিহ্যগতভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে উঠেছিল, যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের এক তরফা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে। এশিয়া ডিকোডেড গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রিয়াঙ্কা কিশোর এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মনে করুন, একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে হচ্ছিল চীনকে ঠেকানোর জন্য। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে ভারত হতবাক। তাহলে (চীনের দিকে ঝোঁকা) এটি এক বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির বিশৃঙ্খলার মধ্যে চীনও ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সংহতিকে স্বাগত জানাবে। তাই মোদির এই সফরে তাৎক্ষণিক কিছু সহজ সাফল্য দিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার ঘোষণা এরই মধ্যে এসেছে। ভিসার নিয়মে আরো শিথিলতা এবং কিছু আর্থিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর চেয়েও গভীর অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগ বিদ্যমান। ভারত তার উৎপাদন খাতের জন্য এখনো চীনের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। অন্যদিকে চীনা সংস্থাগুলো ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশের জন্য অধীর আগ্রহী। প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘দ্রুত ভিসা অনুমোদন চীনের জন্য একটি সহজ অর্জন হতে পারে। তারা ভারতে সরাসরি অথবা বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজারে প্রবেশাধিকার চায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সংকুচিত, আসিয়ান বাজারে তারা আগেই জায়গা করে নিয়েছে, আর শেইন, টিকটকের মতো অনেক চীনা অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ। বেইজিং ১.৪৫ বিলিয়ন মানুষের বাজারে বিক্রির সুযোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাবে।
তবে একটি বৈঠকেই সব সমস্যার সমাধান হবে, এমনটা আশা করা বাতুলতা। ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নয়নের পথ এখনো দীর্ঘ ও প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ। কিন্তু মোদির এই চীন সফর দুই দেশের মধ্যকার বৈরিতা কমাতে এবং ওয়াশিংটনকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছে।