Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

জোড়াতালির কূটনীতি ভারতকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

Icon

স্বর্ণা রায়

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:১৩

জোড়াতালির কূটনীতি ভারতকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

প্রতীকী ছবি

২০২০ সালে প্রকাশিত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার বই ‘দি ইন্ডিয়া ওয়ে : স্ট্র্যাটেজিস ফর এন আনসার্টেন ওয়ার্ল্ডে’ লিখেছিলেন, ‘এটি এমন এক সময়, যখন আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে, চীনকে সামলাতে হবে, ইউরোপকে কাছে টানতে হবে, রাশিয়াকে আশ্বস্ত করতে হবে, জাপানকে সঙ্গে আনতে হবে, প্রতিবেশীদের টেনে আনতে হবে এবং ঐতিহ্যগত সমর্থনশক্তি সম্প্রসারণ করতে হবে।’

জয়শঙ্কর এই যে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের স্বপ্ন এঁকেছিলেন, যেখানে ভারত এক পা ওয়াশিংটনে রাখবে, এক পা মস্কোয়, আর সতর্কের চোখে বেইজিংকে দেখবেÑভারত কি সত্যিই সেই উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণের পথে এগোচ্ছে? নাকি ভারসাম্য রক্ষার এই খেলা তাকে আরো বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যেন এখন এক গোলকধাঁধা। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখরাঙানি ও শুল্কের বোঝা; অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে রহস্যময় বৈঠক, আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সস্তা তেলের হাতছানি। সব মিলিয়ে যেন দিল্লিতে এক টানাপড়েনের মহানাটক চলছে। সম্প্রতি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ২০২০ সালে সীমান্তে প্রাণঘাতী সংঘাতের পর দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, চীনের এই আমন্ত্রণ তা প্রশমিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র এখন শুধু ভারতের বন্ধু নয়, রীতিমতো সমালোচক। রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে মস্কোর ‘যুদ্ধকালীন অর্থনীতিকে’ শক্তিশালী করার অভিযোগ উঠেছে দিল্লির বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদির আসন্ন বৈঠককে বিশ্লেষকরা ‘বিজয়োল্লাসের কূটনীতি’ না বলে ‘বাস্তববাদী সমঝোতার চেষ্টা’ হিসেবে দেখছেন। গালওয়ান সংঘর্ষের পর শীতল হওয়া সম্পর্ক নতুন করে উষ্ণ করার এক সতর্ক পদক্ষেপ এটি। 

ভারত একদিকে ওয়াশিংটন-নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াডের (জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট) সদস্য। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া-নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) অংশ। যদিও মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া এই এসসিওতে ভারতের উপস্থিতি বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের জোট আইটুইয়ুটু’তেও সক্রিয়। আবার একই সঙ্গে ফ্রান্স ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও ভারতের ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগ চলছে। এ যেন এক কূটনৈতিক জোড়াতালির দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।

ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিতেন্দ্র নাথ মিশ্রের মতে, ‘হেজিং (দুই দিকেই ভারসাম্য রাখা) ভালো সিদ্ধান্ত নয়। তবে কারো সঙ্গে সরাসরি জোট বাঁধার বিকল্পটি আরো খারাপ। ভারতের সেরা পছন্দ আসলে খারাপ পছন্দটাইÑঅর্থাৎ হেজিং।’ 

চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উচ্চাকাক্সক্ষা বনাম বাস্তবতা

ভারতের বৈশ্বিক উচ্চাকাক্সক্ষা তার বর্তমান সামর্থ্যরে চেয়ে অনেক বেশি। চার ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তাকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম শক্তি বানালেও চীনের ১৮ ট্রিলিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ ট্রিলিয়নের তুলনায় তা নগণ্য। সামরিক শিল্পেও ভারত এখনো পিছিয়ে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক হলেও রপ্তানিকারকদের তালিকায় ভারতের নাম নেই। দেশীয় উৎপাদনের বুলি আওড়ালেও উচ্চমূল্যের সামরিক প্রযুক্তির জন্য ভারত এখনো বিদেশনির্ভর। আবার চীনের সঙ্গে ভারতের ৯৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি, যা ভারতের ২০২৫-২৬ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটকেও ছাড়িয়ে গেছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পরও ভারত নতি স্বীকারের কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। মস্কো থেকে সস্তায় তেল ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এক আশীর্বাদ। জয়শঙ্করের মস্কো সফর বুঝিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আর রাশিয়ার চীন নির্ভরতার মাঝেও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে চায় দিল্লি, যা একদিকে জ্বালানি সুরক্ষা, অন্যদিকে নিজের পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীনতার প্রতীক।

ভারতের ভবিষ্যৎ কী?

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশ্লেষক অ্যাশলে টেলিস যুক্তি দিয়েছেন, ভারতের বহু মেরুকেন্দ্রিকতার কৌশল তার নিরাপত্তাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। 

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো ভারত ও চীনের ওপরে প্রভাবশালী থাকবে। তাই ভারতের উচিত ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘বিশেষ অংশীদারি’ গড়ে তোলা, যাতে চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নয়তো চীনের মতো এক ‘শত্রুভাবাপন্ন পরাশক্তির’ সামনে ভারত দুর্বল হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও মনে করেন, বিশ্ব এখন দুই শিবিরে বিভক্ত হচ্ছে না, বরং আরো জটিলভাবে ভাঙছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের কৌশলগত দুর্বলতা নয়, বরং স্বায়ত্তশাসন দরকার। এই পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেই একটি বিষয় স্পষ্ট, যে চীন-নেতৃত্বাধীন, রাশিয়া-সমর্থিত, যুক্তরাষ্ট্রবিহীন বিশ্বব্যবস্থার ধারণায় ভারত গভীর অস্বস্তি বোধ করছে।

ভারতীয় মার্কিন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সুমিত গাঙ্গুলি বলেন, ‘খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে ভারতের বিকল্প সীমিত। চীনের সঙ্গে স্থায়ী সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা নেইÑপ্রতিদ্বন্দ্বিতা টিকে থাকবে।’ রাশিয়াকে তিনি সীমিত মাত্রায় নির্ভরযোগ্য মনে করেন। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে তিনি আশাবাদী। ট্রাম্প হয়তো আর তিন বছর ক্ষমতায় থাকবেন, তবুও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক টিকে থাকবে। দুই দেশের এত বড় স্বার্থ জড়িয়ে আছে যে, ট্রাম্পের খামখেয়ালির কারণে তা ভেঙে পড়বে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫