Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলের নজর এখন তুরস্কের দিকে

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:২৭

ইসরায়েলের নজর এখন তুরস্কের দিকে

ছবি : সংগৃহীত

আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে ইরান তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ইসরায়েল ও তুরস্ক ওপরের দিকে উঠছে-তেল আবিব ও আঙ্কারার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনিবার্য হয়ে উঠছে। প্রশ্ন এটা নয় যে, সংঘর্ষ হবে কি হবে না; বরং তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সরাসরি সংঘর্ষের মাধ্যমে, নাকি ভিন্ন কোনো পথে।

ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনই এই সম্ভাব্য সংঘাতের মূল কারণ। বিষয়টি বোঝার জন্য একটু পেছনে ফেরা যাক। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য আমূল পাল্টে দেয়, আর উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের পরাজয় আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল। তখন ইরান ও ইসরায়েল দুই প্রধান শক্তি হিসেবে উঠে আসে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল তার দীর্ঘদিনের কৌশল উল্টে দেয়, যেটা ছিল ডকট্রিন অব দ্য পেরিফেরি বা ‘প্রান্তবর্তী কৌশল’। এই কৌশল অনুযায়ী, ইসরায়েল তার চারপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভারসাম্যহীন করতে আশপাশের অ-আরব রাষ্ট্রগুলোর (ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়া) সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর ইসরায়েলের জন্য কোনো আরব রাষ্ট্র আর প্রচলিত সামরিক হুমকি হিসেবে অবশিষ্ট থাকেনি। ফলে তাদের দৃষ্টি সরতে শুরু করল ইরানের দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আশির দশকে ইরানের প্রবল ইসরায়েল বিরোধিতা ততটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি ইসরায়েল। কারণ তাদের মনোযোগ তখন ছিল ইরাক ও আরব দেশগুলোতে। এমনকি খামেনি যুগেও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল ইসরায়েল। 

পরিবর্তিত বাস্তবতায় ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি আনতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে ইরানের ‘ইসলামি মৌলবাদ’ মোকাবিলা করতে হবে; অর্থাৎ ইরানকে নিষেধাজ্ঞা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ফেলতে হবে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি শান্তি যত অগ্রসর হবে, ইরান তত বেশি একঘরে হয়ে পড়বে। আর ইরান যত একঘরে হবে, ইসরায়েল-আরব শান্তি ততই মজবুত হবে। ততদিনে ‘ওয়ার অন টেরর’ বা ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। 

তিন দশক ধরে এই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুক্তি দুই পক্ষকেই চালিত করেছে-ইসরায়েল চেষ্টা করেছে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করতে, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান কূটনীতি ব্যাহত করতে, সম্ভাব্য সব চুক্তি নষ্ট করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলতে। অন্যদিকে ইরান ইসরায়েলকে সব জায়গায় চ্যালেঞ্জ করেছে, ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতা কাটানোর চেষ্টা করেছে।

সম্প্রতি ইসরায়েল কয়েকটি বড় সাফল্যও পেয়েছে। ইসরায়েল এখন পুরোপুরি বিজয়ী নয়; কিন্তু তারা এরই মধ্যে নজর দিচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্রের দিকে, যেটিকে দুর্বল না করলে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আধিপত্য কায়েম করতে পারবে না। সেটি হলো তুরস্ক। ইসরায়েলের কৌশল কেবল ভারসাম্য সৃষ্টি নয়, বরং পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।

সিরিয়ায় তুরস্কের সাফল্য দেশটিকে আরো বেশি ইসরায়েলের রাডারে এনেছে। তবে তুরস্ক ইরানের মতো নয় : এটি ন্যাটো ও জি২০-এর সদস্য, এর অর্থনীতি সহজে নিষেধাজ্ঞায় ভাঙা সম্ভব নয়। এটি সুন্নি শক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যে এর নরম শক্তি শিয়া ইরানের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। অবশ্য তুরস্কের দুর্বলতাও আছে-যেমন কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। আর তা বুঝতে পেরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আগেভাগেই কুর্দিদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছেন। 

কিন্তু যতদিন ইসরায়েল মনে করবে যে তাদের নিরাপত্তা কেবল প্রতিবেশীদের সামরিকভাবে দমন করেই নিশ্চিত করা সম্ভবÑতাদের অভিপ্রায় থাকুক বা না থাকুকÑততদিন তুরস্কও প্রধান শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের নিশানায় থাকবে। সিরিয়ায় ক্রমাগত সামরিক হামলা চালিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ইসরায়েল সীমানা পার হয়ে গোলান মালভূমির একের পর এক জায়গা দখলে নিচ্ছে। 

এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে এবং নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে তুরস্ক। এই পদক্ষেপ অভূতপূর্ব ও সুদূরপ্রসারী পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. হায় ইটান কোহেন-ইয়ানারোকাক। ইসরায়েলি মারিভ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘একটি দেশ কেবল যুদ্ধকালেই অন্য একটি দেশের সঙ্গে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের পদক্ষেপ নজিরবিহীন, যা পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে একেবারে সরিয়ে দেয় এবং তা কৌশলগত সংঘাতে রূপ নিতে পারে।’ এর আগে ইসরায়েল যেদিন গাজায় সামরিক অভিযান সম্প্রসারণের ঘোষণা দেয়, সেদিনই তুরস্ক সামুদ্রিক নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইসরায়েলি বাহিনী সম্প্রতি নজরদারি যন্ত্রপাতি দামেস্কে বিক্রি করছে বলে দাবি করে। সেটিই তুরস্ককে শেষ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা দিতে প্ররোচিত করে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ঘটনা আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল, শুধু একটা উপলক্ষের অপেক্ষায় ছিল তুরস্ক। তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এখন রাশিয়া, জর্জিয়া ও আজারবাইজানে ফ্লাইটগুলো দীর্ঘপথ ঘুরে যেতে হবে। সেই সঙ্গে তুর্কি এয়ারলাইনস আর ইসরায়েলের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না; কিন্তু প্রকৃত বিপদ আরো গভীরে। কোহেন সতর্ক করেন, ‘যখন দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিলীন হয়ে যায়, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কারণ তখন হারানোর কিছু থাকে না। অর্থনীতি, পর্যটন বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থাকলে দুই পক্ষই একে-অপরের ক্ষতি করার আগে দুইবার ভাবত। কিন্তু এখন সেই সংযম আর থাকছে না।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫