Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন নেভি সিলের গোপন মিশন

Icon

স্বর্ণা রায়

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৫০

উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন নেভি সিলের গোপন মিশন

২০১৯ সালের এক রাতে জাপান সাগরের গভীরে একটি পারমাণবিক সাবমেরিন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো দুটি ছোট, স্টিলথ সাবমেরিন। ভেতরে বসা মার্কিন নৌবাহিনীর কিংবদন্তি ‘নেভি সিল টিম-৬’-এর রেড স্কোয়াড্রনের সদস্যরা, যাদের হাতে একদিন শেষ হয়েছিল ওসামা বিন লাদেন। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল আরো ভয়ংকর ও সংবেদনশীল-উত্তর কোরিয়া। 

টিমটি উত্তর কোরিয়ায় একটি গোপন অভিযান পরিচালনা করেছিল, যা কয়েকজন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার মধ্য দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে সম্প্রতি খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুমোদনে পরিচালিত এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের যোগাযোগের তথ্য হাতিয়ে নিতে একটি স্পাই ডিভাইস বা আড়িপাতার যন্ত্র স্থাপন করা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই মিশনটির দায়িত্বে ছিল নেভি সিলের সবচেয়ে এলিট ইউনিট ‘রেড স্কোয়াড্রন’, যারা ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানে অংশ নিয়েছিল। 

ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনা চলার সময় উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি পূরণে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মিশনটি এতটাই সংবেদনশীল ছিল যে এর ব্যর্থতা পারমাণবিক আলোচনাকে ভেস্তে দিতে অথবা মার্কিন সেনাদের জিম্মি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারত।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে দুটি ছোট স্টিলথ সাবমেরিনে করে সিল সদস্যরা উত্তর কোরিয়ার উপকূলে পৌঁছানোর কথা ছিল। মাসের পর মাস ধরে কনকনে ঠান্ডা পানিতে অনুশীলন সেরেছিলেন এই কমান্ডোরা। 

পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত। তারা উত্তর কোরিয়ার তীরে পৌঁছাবেন, আড়িপাতার যন্ত্রটি স্থাপন করবেন এবং ভোরের আলো ফোটার আগেই রাতের অন্ধকারে মিশে যাবেন। কেউ কিছুই জানতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব সব সময় পরিকল্পনার ধার ধারে না।

উপকূলে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করেই তাদের চোখে পড়ল একটি অনুজ্জ্বল আলো। একটি ছোট মাছ ধরার নৌকা, যা তাদের গোয়েন্দা তথ্যে থাকার কথাই ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে সব উত্তেজনা বদলে গেল আতঙ্কে। নৌকার আলোকরশ্মি যখন কমান্ডোদের দিকে ঘুরে গেল, তখন একজন সিনিয়র সিল সদস্যের আঙুল চলে গেল ট্রিগারে। ধরা পড়ার ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ ছিল না।

প্রথমে একটি গুলি, তারপর আরো কয়েকটি। শান্ত ও নিস্তব্ধ রাতটি ভারী হয়ে উঠল বারুদের গন্ধে। নৌকায় থাকা মানুষগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তারা কোনো সৈন্য ছিল না, ছিল নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক-ঝিনুক আর শামুক কুড়িয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করত।

মিশন ততক্ষণে ব্যর্থ। সিল সদস্যরা জানতেন, ডিভাইস স্থাপন করা এখন অসম্ভব। এরপর শুরু হয় প্রমাণ লোপাটের নির্মম অধ্যায়। নিহতদের দেহ পানিতে ফেলে দেওয়ার আগে ফুসফুস ছুরি দিয়ে ফুটো করে দেওয়া হয়, যাতে দেহগুলো আর কখনো ভেসে না ওঠে। রাতের অন্ধকার যেমন তাদের নিয়ে এসেছিল, তেমনই গিলে ফেলল তাদের অপরাধ। তারা ফিরে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক রক্তাক্ত ব্যর্থতার গল্প।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতদের সংখ্যা ছিল দুই থেকে তিনজন। ওয়াশিংটনে এই অভিযানের খবর সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। এমনকি কংগ্রেসের সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোও কিছুই জানতে পারেনি। এর কয়েক সপ্তাহ পরই ভিয়েতনামের হ্যানয়ে ট্রাম্প ও কিমের বহু প্রতীক্ষিত বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। উত্তর কোরিয়া আবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করে। বিশ্ব তখনো জানত না, এই কূটনৈতিক ব্যর্থতার পেছনে লুকিয়ে ছিল এক গোপন হত্যাকাণ্ডের ছায়া।

এই ঘটনার পর মার্কিন স্যাটেলাইটে ওই এলাকায় উত্তর কোরিয়ার সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়টি ধরা পড়ে। তবে পিয়ংইয়ং পুরো ঘটনাটি জানতে পেরেছিল কি না, তা আজও স্পষ্ট নয়। দেশটির পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, নিজেদের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে উত্তর কোরিয়া বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকতে পারে।

অভিযানটি মার্কিন আইন লঙ্ঘন করতে পারে, কারণ কংগ্রেসের সংশ্লিষ্ট তদারকি কমিটিগুলোকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ট্রাম্প এ বিষয়ে কিছু জানার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি এখন প্রথমবার এটি শুনছি।’ পেন্টাগন এই অভিযানের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের বিষয়টি জানায় এবং একটি তদন্ত শুরু করে, যার ফলাফল এখনো গোপন রাখা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫