গাজায় গণহত্যা: ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করল জাতিসংঘ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:০৫

‘পাপী শহর’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে নেতানিয়াহু গোটা গাজাকেই প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন। এই প্রথম জাতিসংঘের কোনো তদন্ত সংস্থা সরাসরি ইসরায়েলকে এমন ভয়াবহ অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছে বলে মঙ্গলবার প্রতিবেদন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কমিশন বলেছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ, লিঙ্গীয় নিপীড়নসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ করেছে। এর মধ্যে গণহত্যার মতো অপরাধও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্তব্য এবং গাজায় অভিযানের ধরন বিশ্লেষণ করে কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ফিলিস্তিনিদের একটি গোষ্ঠী হিসেবে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে তারা।
তবে ইসরায়েল এই প্রতিবেদনকে তাৎক্ষণিকভাবে ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। জেনেভায় জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি মিশন বলেছে, এই কমিশন ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি পদ্ধতিগত বৈষম্যমূলক প্রচারণা’ চালাচ্ছে।
ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গাজার অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা সেখানে দুর্ভিক্ষের সতর্কতা দিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০২১ সালে এই স্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান নাভি পিল্লাই।
কমিশনের প্রতিবেদনে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি অপরাধের মধ্যে চারটির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে:
গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা: বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং সুরক্ষিত স্থাপনায় হামলা চালিয়ে মৃত্যু ঘটানো।
গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি: বেসামরিকদের ওপর সরাসরি হামলা, আটককৃতদের ওপর নির্যাতন এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি।
ধ্বংস ডেকে আনার মতো জীবনযাপন চাপিয়ে দেওয়া: জরুরি অবকাঠামো ধ্বংস, চিকিৎসা সেবায় বাধা, খাদ্য, পানি ও জ্বালানির প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া।
জন্ম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: গাজার সবচেয়ে বড় ফার্টিলিটি ক্লিনিকে হামলা চালিয়ে প্রায় চার হাজার ভ্রূণ এবং এক হাজার শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ধ্বংস করা।
গণহত্যার আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার নির্দিষ্ট চেষ্টা বা ইচ্ছা থাকতে হয়। কমিশন বলছে, ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের মতো শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য গণহত্যার প্ররোচনা হিসেবে কাজ করেছে।
কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই বিবিসিকে বলেন, “৭ অক্টোবরই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যেখানে হামাস লুকিয়ে আছে, সেই পাপী শহরকে আমরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করব।”
পিল্লাইয়ের মতে, ‘পাপী শহর’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে নেতানিয়াহু গোটা গাজাকেই প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটিকে ‘বিকৃত ও মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, তিন সদস্যের এই কমিশন ‘হামাসের প্রতিনিধি’ হিসেবে কাজ করছে এবং তাদের প্রতিবেদন ‘হামাসের মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল’।
তিনি আরও বলেন, “বরং হামাসই ইসরায়েলে গণহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে এবং প্রতিটি ইহুদিকে হত্যার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে।”
ইসরায়েলি সরকার বরাবরই বলে আসছে, তাদের অভিযানের লক্ষ্য হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা, গাজার জনগণের বিরুদ্ধে নয় এবং তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার চেষ্টা করছে।
এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা করে, যা এখনও বিচারাধীন। আইসিজে গাজায় মানবিক সংকট মোকাবেলায় ইসরায়েলকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
জাতিসংঘের এই নতুন প্রতিবেদন সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে আরও প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।