মণিপুরে মোদির লোকদেখানো সফরে বিভাজনের স্বীকৃতি

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০২

নরেন্দ্র মোদির সফরে জাতিগত বিভাজনের রেখা স্বীকৃতি পেলো ছবি : এএফপি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কার্যত গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মণিপুর রাজ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্ত সফর করেছেন। ২০২৩ সালের মে মাসে সহিংসতা শুরুর পর থেকে সময় পার হলো ২৮ মাস। এ সময়ে মণিপুর দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। অথচ মুসলিম, মঙ্গলসূত্র, মাংস ভক্ষণ নিয়ে একের পর এক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেলেও মণিপুরের আগুন নেভানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদির সরকার নেয়নি। বরং সংকট জিইয়ে রেখে এখন তিনি এই সফরে বিভাজনকেই স্বীকৃতি দিলেন কৌশলে।
মোদির দল বিজেপি এই সংক্ষিপ্ত সফরটিকে উদ্বেগ প্রকাশের প্রতীক হিসেবে দেখাতে চাইছে; কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সহিংসতা শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মণিপুরে গিয়ে ত্রাণশিবির পরিদর্শন করেন, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দেখা করেন; কিন্তু মোদি দীর্ঘ সময় ধরে মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন। মণিপুর যখন দাউদাউ করে জ্বলছিল, তখন তিনি সেখানে যাননি, ঘটনাও অস্বীকার করেছেন।
২০১৭ সালে মণিপুরে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, ‘যারা রাজ্যে শান্তি নিশ্চিত করতে পারে না, তাদের শাসন করার অধিকার নেই।’ আজ এই কানফাটা বুলি শুনতে ভীষণ ফাঁপা লাগে। কারণ তার সরকারের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা গত ২৮ মাসে এই সংকটকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই উদাসীনতার ফল ভোটে দেখা গেছে-২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মণিপুরের দুটি আসনেই বিজেপি হেরে যায়, কংগ্রেস উভয়টি জিতে নেয়। এই পরাজয় ছিল ভয়াবহ, কোনো অজুহাত বা ব্যাখ্যার সুযোগ রাখেনি। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি না হলে তিনি বেরিয়ে আসতেন না এই আত্ম-আরোপিত নির্বাসন থেকে। তার বিলম্বিত সফর শুধু দেখিয়ে দিল, মণিপুরে যেসব অমীমাংসিত প্রশ্ন আজও জ্বলছে, তাদের একটিও সমাধান হয়নি।
লুট হওয়া অস্ত্র ফেরত না আসা
সহিংসতার শুরুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই মিলিশিয়ারা ইম্ফলের সরকারি অস্ত্রাগার থেকে ৬ হাজারের বেশি আধুনিক অস্ত্র একে-৪৭ থেকে শুরু করে মর্টার পর্যন্ত লুট করে নেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বারবার আশ্বাসের পরও বেশির ভাগ অস্ত্র ফেরত আসেনি। এই অস্ত্রগুলোই এখন সহিংসতার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখছে এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে কার্যত অস্বীকার করছে। মোদির সরকার রাষ্ট্রের অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকৃত শান্তি এখনো মরীচিকা।
ন্যায়বিচার
ভুক্তভোগীরা, বিশেষত কুকি-জো জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচারকে এখন ফাঁকা বুলি হিসেবেই দেখছে। ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ ভয়াবহ অপরাধের জন্য প্রায় কোনো দণ্ড হয়নি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধীর, অনিচ্ছা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ লক্ষণীয়। পার্লামেন্টে ‘কঠোর ব্যবস্থা’র প্রতিশ্রুতি দিলেও অপরাধীদের টিকিও স্পর্শ করা হয়নি। ফলে নিহতদের পরিবারগুলো সামান্য স্বীকৃতির জন্যও হাহাকার করছে। ন্যায়বিচারহীন শান্তির খোঁজ বৃথা; মোদির ঘোষিত তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে সেটা পূরণ করা যাবে না।
জাতিগত রেখায় বিভক্ত রাজ্য
আজকের মণিপুর রাজ্য আজ কার্যত বিভক্ত। সিআরপিএফ ও আসাম রাইফেলস এখন মেইতেই অধ্যুষিত ইম্ফল উপত্যকা ও কুকি-প্রধান পার্বত্যাঞ্চলের মাঝে এক জাতিগত সীমারেখা পাহারা দিচ্ছে। নাগরিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বদলে এই ডি-ফ্যাক্টো বিভাজন এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে, গড়ে উঠেছে সমান্তরাল প্রশাসন। মোদির সরকার এই বিভাজন মেনে নিয়েছে-এমনকি নিজে দুই পৃথক স্থানে সফর করে তিনি বিভক্ত অবস্থাকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন, সব সম্প্রদায়কে একত্র করার কোনো সাহসী পদক্ষেপ তিনি নেননি।
বীরেন সিং অডিও কেলেঙ্কারি
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট চলতি বছরের নভেম্বরে বীরেন সিংয়ের অডিও রেকর্ডিং মামলার পরবর্তী শুনানি করবেন। অভিযোগ আছে, এই টেপে মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে সহিংসতা উসকে দিতে এবং মেইতেই গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্রাগার লুটের অনুমতি দিতে শোনা গেছে। ফরেনসিক বিশ্লেষণে বিলম্ব এবং কেন্দ্রের টালবাহানা থেকে ধারণা
করা হচ্ছে বিজেপি অনুগতদের বাঁচাতে এক রকম সুরক্ষা চক্র তৈরি করেছে। এই দলীয় পক্ষপাতই মণিপুরে প্রকৃত পুনর্মিলনের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
মণিপুরে যেতে বাধা
মিয়ানমার সীমান্তে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ বা মুক্ত গমনব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তপারের জাতিগত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই গোষ্ঠীগুলো এটিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম রাজ্যের প্রতিবাদ এবং মণিপুরের নাগা ও কুকি-জোদের আবেদন সত্ত্বেও মোদি সরকার সীমান্তে কাঁটাতার বসানো এবং স্থানীয়দের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্তে অটল। সবকিছুই চলছে তথাকথিত ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র ছুতোয়। এর ফলে এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর আস্থা অর্জনের বদলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আরোপিত কৃত্রিম সীমান্ত পারাপারে যে মানবিকতা আনা হয়েছিল, সেটিকেই উল্টে দিচ্ছে মোদি সরকার।
নাগা চুক্তি বাস্তবায়ন
মণিপুরে নাগারা দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তারা তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছে। মোদি যাকে ২০১৫ সালে নাগাদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ হিসেবে প্রচার করেছিলেন, তা আজ ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় এক দশক পরও কোনো সমাধান হয়নি। আলোচনাগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, নাগাদের মধ্যে হতাশা ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে, তারা আর মোদির কথায় আস্থা রাখতে পারছে না।
আফিম চাষ সংকট
মণিপুরের আন্তঃসীমান্ত মাদক বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়া আরো গভীর হয়েছে। যেসব সম্প্রদায় জীবিকার তাগিদে আফিম চাষে নির্ভরশীল, তাদের জন্য বাস্তব সমাধান খোঁজার বদলে সরকার একে দমনমূলকভাবে দেখছে। পুরো জাতিগোষ্ঠীকে ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করে দারিদ্র্যকেই অপরাধ বানিয়ে ফেলেছে। কুকি-জো জনগোষ্ঠীকে বলির পাঁঠা বানানো জাতিগত বিভাজনের আগুনে ঘি ঢেলেছে, যা গত ২৮ মাসে সহিংসতাকে আরো উসকে দিয়েছে।
পরিকল্পিত ইন্টারনেট বন্ধ
মণিপুরে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ইন্টারনেট শাটডাউন হয়েছে, রাজ্যটি কার্যত ডিজিটাল জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নির্বিচার ইন্টারনেট বন্ধে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সাংবাদিকরা কাজ করতে পারছেন না, মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর চেপে রাখা সম্ভব হয়েছে। এটি শৃঙ্খলা আনার জন্য নয়, নিছক দমন-পীড়নের অস্ত্র, যা প্রমাণ করে ২১ শতকেও ভারত সরকার ঔপনিবেশিক শাসনের কৌশলে স্বচ্ছন্দ। ফলে শিক্ষাসেবা ও সরকারি পরিষেবাগুলো ব্যাহত হচ্ছে, আর জনগণের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে ওঠার উপায়ও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন সংকট
৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ এখনো ত্রাণশিবিরে আটকে আছে। বাড়ি ফেরা অনেক দূরের কথা। অসংখ্য গ্রাম পুড়ে ছাই, অথবা চিরতরে বদলে গেছে; শত শত গির্জা ধ্বংস হয়েছে। সরকারের প্রতিক্রিয়া নিছক আমলাতান্ত্রিক, বড় পরিসরের পুনর্বাসন বা পুনর্মিলনের কোনো স্পষ্ট নীতি নেই। নাগরিকরা যেন দ্বিগুণ ভুক্তভোগী-প্রথমে সহিংসতার, পরে শাসনব্যবস্থার অদক্ষতার।
সহিংসতা শুরুর পর মোদির এই প্রথম মণিপুর সফর নিছকই রাজনৈতিক প্রদর্শনী, মানবিক বিপর্যয়ের কোনো বাস্তব প্রতিক্রিয়া নয়। দীর্ঘ ২৮ মাস নীরবতাই ছিল তার একমাত্র বার্তা, যা ভোটে ভরাডুবি ও লাগাতার সমালোচনার পর টেকেনি। মণিপুর এখন এমন নেতৃত্ব চায়, যারা মানুষকে গুটিকয়েক দাবার ঘুঁটির মতো নয়, পূর্ণ নাগরিক হিসেবে মূল্য দেবে। ক্ষত আর ব্যর্থতাগুলো প্রহসনমূলক সফর বা ফাঁকা ঘোষণায় সারবে না। এর জন্য দরকার জবাবদিহি আর প্রকৃত পদক্ষেপ, যা মোদি সরকার কোনোভাবেই দেখাতে পারেনি।