Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি যে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে

Icon

ইমরানুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৩

সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি যে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে

সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি (এসএমডিএ) মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই চুক্তি কেবল দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর প্রভাব সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এবং বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সুদূরপ্রসারী হতে পারে। 

এই চুক্তির প্রধানতম দিকটি হলো, যদি কোনো দেশ আক্রান্ত হয়, তবে অন্য দেশ সেটিকে নিজেদের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবে এবং যৌথভাবে তার মোকাবিলা করবে। এই ধরনের শর্ত সাধারণত সামরিক জোটগুলোর মূল ভিত্তি হয়ে থাকে। এটি অনেকটা ন্যাটোর ধারা ৫-এর মতো, যেখানে কোনো সদস্য দেশের ওপর আক্রমণকে জোটের সব সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই অনেক বিশ্লেষক এটিকে ‘ন্যাটো-ধাঁচের প্রতিরক্ষা চুক্তি’ হিসেবেও অভিহিত করছেন।

সৌদি আরব কেন এমন একটি চুক্তির জন্য পাকিস্তানকে বেছে নিল, তা বোঝার জন্য কিছুটা প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন। পাকিস্তান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। নানা অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হলেও পাকিস্তানই একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ, যার সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে এবং যাদের যুদ্ধ ও সংঘাতের সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

সৌদি আরবও বহু বছর ধরে সামরিক সক্ষমতার আধুনিকীকরণ এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা এখনো সামরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে স্বাবলম্বী নয়। বিশেষ করে ইরান ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের থেকে যে নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে, তা মোকাবিলায় সৌদি আরবকে প্রায়ই বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সামরিক দক্ষতা ও কৌশলগত অবস্থান সৌদি আরবের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায় কাতারে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করার সুযোগ নেই। ফলে পারমাণবিক শক্তিধর কোনো শক্তির ছায়াতলে যদি সৌদি আরবকে আসতেই হয়, পাকিস্তানের কোনো বিকল্প তার হাতে নেই।  

পাকিস্তান বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সামরিক কার্যক্রমে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বহু পুরোনো। সৌদি রাজপরিবারের সুরক্ষায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই চুক্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পাকিস্তান বহু বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান আর্থিক সাহায্যদাতা সৌদি আরব। এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আরো জোরদার হবে। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থান আরো মজবুত হবে।

এই চুক্তি কেবল দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়, এর একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রেক্ষাপট রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্ম দিয়েছে। ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে সক্রিয় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরব তার মিত্রদের নিয়ে একটি শক্তিশালী জোট গঠন করতে চাইছে। এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান সেই জোটে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেবে। 

তবে এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, এতে বাকি আরব দেশগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই চুক্তির কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশও এতে যোগ দিতে পারে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে একটি মুসলিম সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা করে আসছে। এই চুক্তির মাধ্যমে সেই পথ প্রশস্ত হলো। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, এমনকি মিসরের মতো দেশগুলোও ভবিষ্যতে এই জোটে যোগ দিতে পারে। 

যদি এটি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মুসলিম সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তবে এই চুক্তির সফলতার পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, ইরানের দিক থেকে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। ইরান এটিকে তাদের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে পারে এবং এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইরানকে চুক্তির বিষয়ে অবগত করা হয়েছে।

সৌদি আরব ও পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত প্রতিরক্ষা অংশীদারি চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে। এই অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ইউরোপ ও পাকিস্তানের চিরশত্রু ও বিকাশমান অর্থনৈতিক শক্তি ভারতকে হতবাক করেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫