ভিসা ফি বৃদ্ধি
খেসারত দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকেই

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৪

ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এইচ-ওয়ানবি ভিসার বার্ষিক ফি এক লাখ ডলার করার যে নির্বাহী আদেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, তা মার্কিন প্রযুক্তি শিল্প থেকে শুরু করে বৃহত্তর অর্থনীতিতে গভীর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এই পদক্ষেপকে মার্কিন কর্মীদের কর্মসংস্থান রক্ষার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হলেও সমালোচক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকেই খেসারত দিতে হবে। কর্মী ভিসা ফির এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন দক্ষ কর্মীদের মার্কিন মুলুকে আসার হার নিশ্চিতভাবে কমবে, অন্যদিকে দেশটির উদ্ভাবনী ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান হারাতে পারে।
এই ঘোষণার পরই মাইক্রোসফট, জেপি মরগান ও অ্যামাজনের মতো শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলো তাদের এইচ-ওয়ানবি ভিসাধারী কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাগুলোর এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। হাজার হাজার কর্মীর ওপর নির্ভরশীল এই সংস্থাগুলো জানে, নতুন এই নীতির ফলে বিদেশি কর্মী নিয়োগের খরচ বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাবে, যা সরাসরি তাদের ব্যাবসায়িক মডেলে এবং মুনাফায় আঘাত করবে। বর্তমানে যেখানে আবেদন ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সব মিলিয়ে কয়েক হাজার ডলার খরচ হয়, সেখানে নতুন প্রস্তাবিত ফি প্রায় ২০ থেকে ৩০ গুণ বেশি। এই নীতির অসম প্রভাব পড়বে ছোট ও মাঝারি আকারের প্রযুক্তি সংস্থা এবং স্টার্টআপগুলোর ওপর। গুগল বা মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টদের পক্ষে হয়তো এই বিশাল খরচ বহন করা সম্ভব, কিন্তু একটি সম্ভাবনাময় স্টার্টআপের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব একটি বোঝা। এর ফলে নতুন উদ্ভাবনী ধারণাগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা সিলিকন ভ্যালির প্রাণশক্তিকেই দুর্বল করে দিতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই নীতির মূল উদ্দেশ্য মার্কিন কর্মীদের কর্মসংস্থান রক্ষা করা। তাদের যুক্তি, অনেক সংস্থা এইচ-ওয়ানবি প্রোগ্রামের মাধ্যমে কম বেতনে বিদেশি কর্মী এনে মার্কিন কর্মীদের বঞ্চিত করে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই যুক্তি বাস্তবতার পুরো চিত্র তুলে ধরে না। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা ও অর্থ খাতের মতো শিল্পে এমন অনেক বিশেষায়িত পদ রয়েছে, যেখানে চাহিদার তুলনায় দক্ষ মার্কিন কর্মীর অভাব রয়েছে। এই শূন্যস্থান পূরণে বিদেশি মেধাবীরাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়তা করেন।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই নীতির ফলে এক ধরনের মেধা পাচার শুরু হতে পারে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে মেধাবীরা কানাডা, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে পাড়ি জমাবেন, যারা অভিবাসন নীতিতে অনেক বেশি উদার। এই নীতির প্রত্যক্ষ ও সবচেয়ে বড় শিকার হতে চলেছে ভারত। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুমোদিত এইচ-ওয়ানবি ভিসার প্রায় ৭১ শতাংশের বেশি পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিকরা। ভারতের প্রথম সারির তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা, যেমন-ইনফোসিস, উইপ্রো ও কগনিজেন্টের ব্যাবসায়িক মডেল বহুলাংশে মার্কিন ক্লায়েন্টদের ওপর নির্ভরশীল। নতুন ফি কার্যকর হলে তাদের পরিচালন ব্যয় এতটাই বাড়বে যে তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে শেয়ারবাজারে দেখা গেছে।
বিষয়টির আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিবাসন আইনজীবীদের মতে, ভিসা ফি সাধারণত আবেদন প্রক্রিয়ার প্রশাসনিক খরচ মেটানোর জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এক লাখ ডলারের মতো বিশাল অঙ্কের ফি একটি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ, যা কংগ্রেসের অনুমোদিত ক্ষমতার বাইরে হতে পারে এবং এটি আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আরেকটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসেন এই আশায় যে, পড়াশোনা শেষে তারা এইচ-ওয়ানবি ভিসার মাধ্যমে সেখানে কাজ করার সুযোগ পাবেন। এই নতুন নীতি কার্যকর হলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রবিমুখ হতে পারেন, যা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় এবং গবেষণা উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সব মিলিয়ে, এই প্রস্তাবিত নীতি শুধু একটি ভিসা ফি পরিবর্তন নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক দর্শন এবং বৈশ্বিক অবস্থান নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে। এই পদক্ষেপটি কি আসলেই ‘আমেরিকাকে রক্ষা’ করবে, নাকি উদ্ভাবন ও বিশ্ব মেধার কেন্দ্র হিসেবে তার কয়েক দশকের পুরোনো পরিচয়কে মুছে দিয়ে বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেবে, সেই উত্তর সময়ই বলে দেবে।