Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বাড়ছে ব্রিটেনে

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:০৯

হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বাড়ছে ব্রিটেনে

প্রতীকী ছবি

ইংল্যান্ডের লেস্টার, বহু সাংস্কৃতিকতার শহর। ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, আফ্রিকান, ক্যারিবীয়-সব মিলিয়ে বহু জাতি ও ধর্মের মানুষের বসবাস এখানে। বহু দশকের অভিবাসন, পরিশ্রম ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এই শহরের বৈচিত্র্যময় রূপ; কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেস্টারের রাস্তাঘাট যেন বারবার সাক্ষী হয়ে উঠছে ধর্মীয় বিদ্বেষ, প্রবাসী রাজনীতির বিষাক্ত ছায়া ও উগ্র মতাদর্শের সংঘাতের। গত মাসে শহরের মুসলিম-অধ্যুষিত এক এলাকায় হঠাৎই দেখা গেল বজরং দল নামের এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত পতাকা উত্তোলন করতে। ঘটনাটি নিয়ে কেউ কেউ বললেন, এটি হিন্দু উৎসবের অংশ; কিন্তু মানবাধিকারকর্মী রাজীব সিনহার মতে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়কে ভয় দেখানো। ঘটনাটির সময়কালও সেই বার্তাই বহন করে। কারণ এটি ঘটে লেস্টারের ভয়াবহ ২০২২ সালের দাঙ্গার তৃতীয় বার্ষিকীর ঠিক আগে। প্রতীক, স্লোগান আর কৌশল-সব মিলিয়ে এগুলো নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়; বরং হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক উত্থানের নির্দেশক।

লেস্টারের পুরোনো ক্ষত

২০২২ সালের আগস্টে দুবাইয়ে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের পর লেস্টারের রাস্তায় শুরু হয় উত্তেজনা। ভারতীয় সমর্থকরা যখন ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ স্লোগান তুলে, তখন সেটি দ্রুতই সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। দ্য গার্ডিয়ান তখন শিরোনাম করেছিল-খেলার জয়-পরাজয় কেবল আবেগ নয়; এটি প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যকার রাজনৈতিক বিভাজন ও জাতিগত উত্তেজনাকে উসকে দিয়েছে।

আসলে এর শিকড় আরো গভীরে। ২০১৮ সালে এক গুদামকে মসজিদ বানানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ আপত্তি জানিয়েছিল। অনেকের বক্তব্যে ছিল সরাসরি ইসলামবিদ্বেষী-‘এখানে উগ্রপন্থি তৈরি হবে’, ‘নারীদের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে’, কিংবা ‘হিন্দু মন্দিরগুলোর ক্ষতি হবে’। শহরের সামাজিক সহাবস্থানের আবরণ তখনই উন্মোচিত হয়ে পড়ে।

উগ্র মতাদর্শের রপ্তানি

কেউ কেউ বলেন, নতুন অভিবাসীরা ভারতের রাজনীতি থেকে ‘হিন্দুত্ববাদ’ নিয়ে আসছে। কিন্তু আসলে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কিছু সংগঠনই এসব মতাদর্শকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। লেস্টারে কার্যকর রয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), যা ভারতের কুখ্যাত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সহযোগী সংগঠন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় এই সংগঠনের নাম জড়িত ছিল। এটি লেস্টারেও সক্রিয়। তাদের কর্মকাণ্ডে এখনো ভেসে ওঠে বিনায়ক দামোদর সাভারকার ও এম এস গোলওয়ালকারের প্রশংসা, যিনি হিটলারকে ‘শিক্ষক’ মনে করতেন। এ ছাড়া রয়েছে হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ (এইচএসএস), যেটি আরএসএসের আদর্শে বিশ্বাসী সংগঠন। যদিও ব্রিটেনে আরএসএস নিষিদ্ধ নয়, তবুও বিশ্বব্যাপী একে হিন্দুত্ববাদী উগ্র গোষ্ঠী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।

ঘটনাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা

২০২২ সালের দাঙ্গার পর ব্রিটিশ ডানপন্থি চিন্তক হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি দাবি করে, এখানে কোনো সংগঠিত হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থির হাত নেই, মূলত মুসলমানরাই সহিংসতা শুরু করেছে। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা সুবিধাজনক হলেও অসম্পূর্ণ। কারণ দাঙ্গায় যে প্রতীক, পতাকা ও স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছিল-যেমন ‘জয় শ্রীরাম’, তা এখন ভারতে মুসলিম নিপীড়ন ও হত্যার স্লোগান হয়ে উঠেছে। এগুলো কেবল ধর্মীয় ভক্তি নয়; বরং রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী বার্তা। ব্রিটিশ হোম অফিসের একটি ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে তাই স্পষ্ট বলা হয়েছিল ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী উগ্রবাদ’ লেস্টার দাঙ্গার মূল চালিকাশক্তিগুলোর একটি।

আন্তর্দেশীয় উগ্র নেটওয়ার্ক

বিবিসি মনিটরিং ২০২২ সালের দাঙ্গার সময়কার দুই লাখ এক্স পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখেছিল, অর্ধেকের বেশি এসেছে ভারতের ভেতর থেকে। অর্থাৎ এটি কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিক ভুয়া তথ্য নেটওয়ার্কেরও ফল। আজকের বিশ্বে হিন্দুত্ববাদীরা একা নয়। তারা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে 

শ্বেতাঙ্গ-উগ্রবাদী ও জায়নবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। মুসলমানদের ‘সাধারণ শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সাংবাদিক আজাদ ইসা দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো কীভাবে জায়নবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে কাজ করছে।

ব্রিটেনেও একই প্রবণতা। পুলিশের একটি রিপোর্টে সতর্ক করা হয়, স্থানীয় হিন্দুত্ববাদীরা ইউরোপের ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধছে। এমনকি ২০১১ সালের নরওয়ের গণহত্যাকারী ব্রেইভিকও তার মেনিফেস্টোতে হিন্দুত্ববাদের প্রশংসা করেছিলেন। আরেকটি নাম এখানে ঘুরেফিরে আসে-টমি রবিনসন। ইংলিশ ডিফেন্স লিগের এই প্রতিষ্ঠাতা বহুবার হিন্দুত্ববাদীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ২০২২ সালের দাঙ্গার সময় তিনি মুসলমানদের দায়ী করে বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি ‘শত শত মানুষ’ নিয়ে আসবেন। এর আগেও তিনি লন্ডনের সাউথ হলে একটি হিন্দু মন্দিরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

চোখ বন্ধ রাখার পরিণতি

সব মিলিয়ে স্পষ্ট-লেস্টারের দাঙ্গা কেবল স্থানীয় সাম্প্রদায়িক ঝগড়া নয়। এটি হলো একটি বৈশ্বিক প্রবণতার প্রতিফলন, যেখানে ডানপন্থি ও হিন্দুত্ববাদী উগ্রবাদীরা একত্রিত হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণার জন্য। প্রশ্ন হলো ব্রিটেন কি এখনো এসব না দেখে চোখ বন্ধ করে থাকবে? লেস্টার প্রমাণ করেছে, হিন্দুত্ববাদ কেবল ভারতের রাজনীতি নয়; এটি ব্রিটেনের রাস্তাঘাট, উপাসনালয় ও কমিউনিটি সম্পর্কের ভেতর ঢুকে পড়েছে। উগ্র প্রতীক, বিভাজনের বয়ান আর ভুয়া তথ্যের বেড়াজালে সমাজে যে ক্ষত তৈরি হচ্ছে, তা অবহেলা করলে আরো বড় বিপদ আসন্ন।

ব্রিটেন যদি সত্যিই বহুত্বের সংস্কৃতি রক্ষা করতে চায়, তাহলে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থাকে কেবল দূরবর্তী সমস্যা ভেবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটি এখন স্থানীয় সমস্যা, জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যা, আর সবচেয়ে বড় কথা-মানবিক সহাবস্থানের সমস্যা। চোখ বন্ধ করে থাকার মানে হলো, ইসলামবিদ্বেষী বৈশ্বিক সহিংসতাকে আরো শক্তিশালী হতে দেওয়া।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫