আসাদ-পরবর্তী প্রথম নির্বাচন
সিরিয়ায় পরিবর্তনের প্রতীক নাকি অনিশ্চয়তার ছায়া

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:০৭

সিরিয়ায় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ অক্টোবর। গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের পতনের পর এটি দেশটির প্রথম নির্বাচন। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ের বংশানুক্রমিক ও দমনমূলক শাসনের অবসানের পর এই নির্বাচন দেশটির জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। একই সঙ্গে এটি প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার জন্য এক বড় পরীক্ষা। তবে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়।
ভোটে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নেই
সিরিয়ার পার্লামেন্টে এখন মোট আসন ২১০টি; আসাদের সময়ের চেয়ে ৪০টি কম। সদস্যদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই বছর। এই ২১০ আসনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট শারা সরাসরি নিয়োগ দেবেন ৭০ জন সদস্যকে। বাকি ১৪০ জনকে নির্বাচিত করবে আঞ্চলিক সাবকমিটি, যা আবার তদারকি করবে ১১ সদস্যের সুপ্রিম কমিটি-এটিও নিয়োগ দিয়েছেন শারাই। এসব সাবকমিটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, যারা আঞ্চলিক ইলেক্টোরাল কলেজে ভোট দেবেন। সিরীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নাগরিকদের সাধারণ ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়, কারণ প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে এখন পর্যন্ত দেশে নির্ভরযোগ্য জনশুমারি নেই, লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত।
তবে ২১০ আসনের মধ্যে ৩২টি আপাতত শূন্য থাকবে। সিরীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল ও দক্ষিণের সুয়েইদা এলাকায় ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে। এই দুই অঞ্চলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়েছিল।
সিরিয়া বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের ফেলো অ্যারন লুন্ড বলেন, ‘এখানে ভোট হচ্ছে, কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত। নির্বাচনের এই কাঠামোটি এমন যেখানে অধিকাংশ নির্বাচকই বর্তমান শাসকদের পছন্দে বাছাই করা। যদিও এখন সিরিয়া আসাদ আমলের সেন্সরশিপ ও পুলিশি দমননীতি থেকে মুক্ত; তবু প্রকৃত বিতর্ক বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ এখনো নেই।’
প্রার্থী সংখ্যা
নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ভোটগ্রহণ শুরু হয় সকাল ৯টায়, চলেছে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সুপ্রিম কমিটি এক হাজার ৫৭০ জন প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমোদন দিয়েছে। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ১৪০টি নির্বাচিত আসনের জন্য; পরে বাকি ৭০ জনকে মনোনীত করবেন আহমাদ আল-শারা।
কোনো নির্দিষ্ট কোটার বিধান নেই। তবে খসড়া আইনে বলা হয়েছিল, ইলেক্টোরাল কলেজে ২০ শতাংশ নারী, ৩ শতাংশ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং ৭০-৩০ অনুপাতে পেশাজীবী ও ঐতিহ্যবাহী বিশিষ্টজনদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তবে নির্বাচনের আগেই সহিংসতা দেখা দিয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর তারতুস প্রদেশে আলাওয়ি সম্প্রদায়ের প্রার্থী হায়দার শাহিনকে তার বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সরকার ঘনিষ্ঠ আল-ওয়াতান পত্রিকা জানায়, হামলার পেছনে সাবেক শাসনের অনুসারীরা জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে সরকার। তারতুস ছিল মার্চ মাসের সহিংসতার একটি কেন্দ্র, যেখানে আসাদ অনুগতদের ওপর সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞে পরিণত হয়। এর পর থেকে অনেক আলাওয়ি অভিযোগ করছেন যে তারা সাম্প্রদায়িক হুমকি ও বৈষম্যের মুখে পড়েছেন।
সিরীয়দের মনোভাব
মানুষের মধ্যে যেমন আনন্দ, তেমনি সংশয়ও রয়েছে। অনেকেই আসাদ পরিবারের পতনে উচ্ছ্বসিত; তাদের নির্মম শাসনের বিকল্প কিছু দেখলেই স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে অনেকে আবার প্রেসিডেন্ট শারার প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করছেন-বিশেষত তার নিরাপত্তা নীতি ও নির্বাচনে অতিরিক্ত প্রভাবের কারণে। তবু গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন প্রবল। আরব সেন্টারের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ সিরীয় নাগরিক রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও জবাবদিহিসহ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চান। ৮ শতাংশ চান কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়া ইসলামি শরিয়াভিত্তিক শাসন, আর ৬ শতাংশ চান কেবল ইসলামি দলগুলোর অংশগ্রহণে রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
এরপর কী
নিঃসন্দেহে শারা এখন সিরিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর তিনি যে সামরিক অভিযানের নেতৃত্বে আসাদকে অপসারণ করেন, এর পর থেকেই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। তবু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই নির্বাচন আগের মতো ‘ছদ্ম নির্বাচন’ নয়।
অ্যারন লুন্ড বলেন, ‘এবার আপনি কিছু জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও স্থানীয় বিশিষ্টজনদের নির্বাচিত হতে দেখবেন-এটি গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার এখন প্রয়োজন স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে দামেস্কের ক্ষমতা কাঠামোর যোগসূত্র তৈরি করা।’ তার মতে, ‘এটা নিছক নাটক নয়, তবে এটি এখনো এমন নির্বাচন নয়, যা স্বাধীন পার্লামেন্ট গঠন করবে বা রাজনৈতিক শিবিরগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করবে।’
শারার প্রভাব আগামী দিনেও অটুট থাকবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। তবু এটি সিরিয়ার রাজনৈতিক বহুত্ববাদী ভবিষ্যতের পথে এক প্রাথমিক ধাপ হতে পারে। বিপ্লব-উত্তর দেশগুলোর জন্য এটি খুব অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে করেন লুন্ড। তিনি বলেন, ‘শুরুটা কোথাও না কোথাও থেকে করতে হয়। তাই এমন একটি কাঠামো তৈরি হয়, যা অন্তত কিছু না থাকার চেয়ে ভালো।’
এরপর প্রশ্ন উঠবে, নতুন গণপরিষদ আসলে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই গণপরিষদ সত্যিই নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবে ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ পাবে, নাকি কেবল প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের যন্ত্রে পরিণত হবে। এটি কি প্রকৃত নির্বাচনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ, নাকি কেবল একটি ‘টিক বাক্স’ ও নতুন এক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার সূচনা-সেই সিদ্ধান্ত টানার সময় এখনো আসেনি। তবে শঙ্কা ও সম্ভাবনা-দুটিই একত্রে বিদ্যমান। আসাদের পতনের পর বছর না গড়াতেই দেশটি নতুন রাজনীতির পথে পা রাখছে; কিন্তু এই পথ সত্যিই গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন এখনো উন্মুক্ত। এই নির্বাচন তাই একদিকে সিরিয়ার পরিবর্তনের প্রতীক, অন্যদিকে অনিশ্চয়তার ছায়া।