
প্রতীকী ছবি
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনা এক নতুন ও উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। বেইজিং ওয়াশিংটনকে উচ্চ শুল্কের হুমকি দেওয়া বন্ধ করে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। তবে এর সঙ্গে এও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তার দমনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখে, তবে চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। এই পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের কেন্দ্রে রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ঘোষণা, যেখানে তিনি চীনের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি ১ নভেম্বর থেকে সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার রপ্তানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কথাও জানিয়েছেন। এই ঘোষণাটি এমন একসময়ে আসে যখন তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একটি আসন্ন বৈঠক বাতিলের হুমকি দিয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আলোচনার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত উচ্চ শুল্কের হুমকি দেওয়া চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার সঠিক পথ নয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব পথে চলতে থাকে, তবে চীন তার বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য চূড়ান্তভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অবশ্য ওয়াশিংটনের এই কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে চীনের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের কারণে। চীন মার্কিন জাহাজগুলোর ওপর নতুন বন্দর ফি আরোপ করেছে, প্রযুক্তি সংস্থা কোয়ালকমের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত শুরু করেছে এবং বিরল মৃত্তিকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বেইজিং তার এই পদক্ষেপগুলোকে আত্মরক্ষামূলক বলে অভিহিত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরে মাদ্রিদে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পর থেকে চীনের বিরুদ্ধে নতুন নতুন বিধি-নিষেধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।
গত মাসে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ তার রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে একটি নাটকীয় পদক্ষেপ নিয়ে বেইজিংকে অত্যাধুনিক চিপস থেকে দূরে রাখার জন্য বর্তমান ব্যবস্থাগুলোর ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেয়। এর জবাবে চীন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বিশ্ব প্রযুক্তির বাজারে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত সপ্তাহে বেইজিং বিরল মৃত্তিকা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের রপ্তানির ওপর ব্যাপক নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর অধীনে যেসব বিদেশি রপ্তানিকারকের পণ্যে চীন থেকে সংগ্রহ করা বিরল মৃত্তিকার সামান্যতম অংশও ব্যবহৃত হয়, তাদের এখন জাতীয় নিরাপত্তার কারণে একটি রপ্তানি লাইসেন্স নিতে হবে। বিরল মৃত্তিকা প্রক্রিয়াকরণ এবং চুম্বক তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কিছু সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তিও এই নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়েছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা নয় এবং যেসব আবেদন নিয়মকানুন মেনে চলবে, সেগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হবে।
এ ছাড়া মার্কিন জাহাজের ওপর চীনের নতুন বন্দর ফি আরোপের ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন ওয়াশিংটনও মার্কিন বন্দরে আসা বড় চীনা জাহাজগুলোর ওপর নতুন চার্জ আরোপের পরিকল্পনা করেছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ চীনের সামুদ্রিক, লজিস্টিকস ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনার পরিবেশকে ক্ষুণ্ন করেছে, যার তীব্র বিরোধিতা করছে চীন।
দেশটির ভাষ্য মতে, চীনের নেওয়া পদক্ষেপগুলো চীনা শিল্প এবং উদ্যোগগুলোর বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল এবং জাহাজ নির্মাণ বাজারে একটি ন্যায্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চীনের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রযুক্তি জায়ান্ট কোয়ালকমের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। গত সপ্তাহে এই তদন্তের ঘোষণার পর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফর মার্কেট রেগুলেশন ইসরায়েলের অটোটকস লিমিটেড অধিগ্রহণের বিষয়ে কোয়ালকমের সঙ্গে বিনিময়ের বিষয়টি তুলে ধরেছে। সংস্থাটির মতে, কোয়ালকম ২০২৪ সালের মার্চ মাসে বেইজিংকে জানিয়েছিল যে তারা চুক্তিটি বাতিল করবে, কিন্তু তারপর কোনো যোগাযোগ ছাড়াই তারা অধিগ্রহণ সম্পন্ন করে। কোয়ালকমের বিরুদ্ধে তদন্তটি স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে করা হচ্ছে।
এই ঘটনাগুলোর সম্মিলিত প্রভাব বিশ্ববাণিজ্যের ওপর একটি গভীর ছায়া ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপের সঙ্গে লড়াই করছে, তখন এই নতুন বাণিজ্য উত্তেজনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে এবং এর একটি দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।