গাজায় যুদ্ধবিরতির ভয়াবহ লঙ্ঘন, ইসরায়েলি হামলায় নিহত একই পরিবারের ১১ জন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪৫

ধ্বংসস্তুপের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর গোলাবর্ষণে একই পরিবারের ১১ জন নিহত হয়েছেন। আট দিন আগে কার্যকর হওয়া নাজুক যুদ্ধবিরতির পর এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা। এই হামলার পর গাজাজুড়ে আবারও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, যুদ্ধবিরতির নামে ইসরায়েল এখনও অবরুদ্ধ গাজায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় গাজা সিটির জেইতুন এলাকায় এই হামলা হয়। স্থানীয় সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ জানায়, ইসরায়েলি ট্যাংক থেকে ছোড়া একটি গোলা আবু শাবান পরিবারবাহী একটি বেসামরিক গাড়িতে আঘাত হানে। গাড়িটিতে থাকা সবাই নিহত হন।
নিহতদের মধ্যে সাত শিশু ও তিন নারী রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল। তিনি জানান, “পরিবারটি তাদের বাড়ির অবস্থা দেখতে যাচ্ছিল। তাদের সতর্ক করা বা অন্যভাবে থামানো যেত। কিন্তু দখলদার বাহিনী রক্তের পিপাসায় অন্ধ হয়ে নিরপরাধ বেসামরিকদের টার্গেট করেছে।”
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস এই ঘটনাকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বলে নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, কোনো কারণ ছাড়াই বেসামরিক পরিবারটিকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে চাপ দেয়।
হামলার সময় ইসরায়েলি সেনারা গুলিবর্ষণ করে তাদের ওপর, যারা তথাকথিত হলুদ রেখা (ইয়েলো লাইন) অতিক্রম করেছিলেন- যে সীমার ভেতর থেকে ইসরায়েলি সেনাদের যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী সরে যাওয়ার কথা ছিল।
আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারি, যিনি গাজা থেকে জানিয়েছেন- বহু ফিলিস্তিনি এখনও জানেন না ইসরায়েলি বাহিনী কোন এলাকায় অবস্থান করছে, কারণ ইন্টারনেট সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। ফলে অনেক পরিবার অজান্তেই বিপদসীমায় চলে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, খুব শিগগির গাজার এই হলুদ রেখা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হবে। তবে এখনো ইসরায়েলি বাহিনী গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলি বন্দিদের মৃতদেহ ও ফিলিস্তিনি বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া চললেও, এই সময়েই ইসরায়েল অন্তত ২৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং সাহায্যসামগ্রী প্রবেশ কঠোরভাবে সীমিত করেছে।
ইসরায়েল এখনো রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ রেখেছে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথও অবরুদ্ধ করে রেখেছে, যার ফলে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছে, ত্রাণ কাফেলাগুলো দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া এলাকায় পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে গাজার প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ দিনে ছয় লিটারেরও কম পানীয় জল পাচ্ছেন—যা জরুরি মানের নিচে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে তারা গড়ে ৫৬০ টন খাদ্যসামগ্রী প্রতিদিন গাজায় পাঠাতে পেরেছে, যা প্রয়োজনীয় পরিমাণের তুলনায় অনেক কম। ফলে ব্যাপক অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে হামাস জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতির সব শর্ত মেনে চলবে, যার মধ্যে ইসরায়েলি বন্দিদের মৃতদেহ ফেরত দেওয়া অন্তর্ভুক্ত। শুক্রবার সন্ধ্যায় তারা আরও একজন বন্দির দেহ হস্তান্তর করেছে, এতে এখন পর্যন্ত মোট ১০ জনের দেহ ফেরত দেওয়া হয়েছে।
তবে হামাস বলছে, আরও মৃতদেহ উদ্ধার করতে ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, কিন্তু ইসরায়েল এসব সরঞ্জাম গাজায় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে জানান, “ইসরায়েল ভারী যন্ত্রপাতি ঢুকতে না দিয়ে গাজার মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এখানকার মানুষ জানে কীভাবে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার করতে হয়, কিন্তু তাদের হাতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই।”