বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং বস্তুনিষ্ঠতার রক্ষক হিসেবে নিজেদের অবস্থান জাহির করে। যদিও বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাতের সময়ে সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে; মোটা দাগে তা ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে কথা বলেছে। কিন্তু বৈশ্বিক পুঁজিবাদের প্রভাবে অমানবিকতার অধঃপতনে কার্যত অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে মিডিয়া। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া গাজা গণহত্যা এরই মধ্যে দুই বছর পার করেছে। আর তার কভারেজ প্রমাণ করে যে, এই পশ্চিমা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামোগতভাবে পক্ষপাত, নৈতিক আত্মসমর্পণ ও ঔপনিবেশিক আখ্যানের প্রতি গভীর অঙ্গীকারের জালে আবদ্ধ। প্রদত্ত তথ্যগুলো দেখায় যে, পশ্চিমা মিডিয়া সচেতনভাবে ইসরায়েলি গণহত্যাকে বৈধতা দিতে এবং ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে কাজ করছে।
এ ধরনের সাংবাদিকতা কেবল পক্ষপাতদুষ্ট নয়, বরং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ (ওয়ার অন টেরর) এবং ‘ইসলামোফোবিয়া’র মতো দুটি শক্তিশালী পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর সরাসরি ফল। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম কার্যত এখানে মুসলিম পরিচয়কে ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘বিপজ্জনক অপর’ হিসেবে নির্মাণ করে, যার চূড়ান্ত শিকার ফিলিস্তিনিরা।
‘ওয়ার অন টেরর’-এর জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো
৯/১১-এর পর পশ্চিমা বিশ্বে ‘ওয়ার অন টেরর’ যে বাইনারি কাঠামো তৈরি করেছেÑসভ্যতা বনাম বর্বরতা, ভালো বনাম মন্দ, প্রগতি বনাম ইসলাম, তা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু কভারেজ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত একটি ছাঁচ সরবরাহ করে। এই কাঠামোতে ইসরায়েলকে ‘সভ্যতার অগ্রদূত’ এবং হামাস বা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে ‘ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায়ন
পশ্চিমা মিডিয়া ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি ব্যবহারে এখন অনেকটা রাখঢাক ছাড়াই দ্বিচারিতা করে। বিবিসি বা এএফপির মতো প্রতিষ্ঠান সম্পাদকীয় নীতি হিসেবে শব্দটি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করলেও ইসরায়েলি আখ্যানের ক্ষেত্রে সেই সতর্কতা প্রায়ই প্রশ্নাতীতভাবেই থাকে না।
মার্কিন ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চমস্কি তার বহুল আলোচিত ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট : দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য মাস মিডিয়া’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে অভিজাত সংবাদমাধ্যমগুলো একটি ‘প্রোপাগান্ডা মডেল’ অনুসরণ করে, যেখানে সরকার এবং করপোরেট স্বার্থের অনুকূলে সংবাদ পরিবেশিত হয়। ‘ওয়ার অন টেরর’-এর যুগে, ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে তুলে ধরার পশ্চিমা সরকারি স্বার্থকে এই মিডিয়াগুলো নীরবে মেনে নিয়েছে। এই মডেলে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু ইসরায়েলের ‘কাঠামোগত সহিংসতা’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয় না।
চমস্কি আরো বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি কেবল তাদের জন্য সংরক্ষিত, যারা পশ্চিমা শক্তির স্বার্থের বিরোধিতা করে। ইসরায়েল কর্তৃক বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা, যা আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুসারে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ হতে পারে, তা মিডিয়ার শিরোনামে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘অনিচ্ছাকৃত ঘটনা’ হিসেবে লঘু করা হয়।
‘ওয়ার অন টেরর’-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর বিবৃতিকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে গ্রহণ করা। এর বিপরীতে সাংবাদিকতার নীতি হলো ক্ষমতার প্রতি প্রশ্ন তোলা; কিন্তু এই কাঠামোর অধীনে সামরিক মুখপাত্রের কথা চ্যালেঞ্জ করা ‘জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থি’ বলে বিবেচিত হয়।
সিএনএনের আত্মসমর্পণের সামরিক প্রেক্ষাপট
সিএনএনের সংবাদদাতা জেরেমি ডায়মন্ডের ‘এমবেডেড জার্নালিজম’ এবং সামরিক সেন্সরশিপের শর্ত মেনে নেওয়া এই কাঠামোরই ফসল। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাবেক পররাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক ডেভিড ইগনেশিয়াসের মতে, এই ধরনের ‘এমবেডিং’ সাংবাদিককে একটি সামরিক বলয়ে আবদ্ধ রাখে। কিন্তু ‘ওয়ার অন টেরর’-এর রাজনৈতিক আবরণে এই আত্মসমর্পণকে ‘সাহসী রিপোর্টিং’ হিসেবে প্রচার করা হয়, যা সাংবাদিকতাকে কেবল প্রোপাগান্ডায় রূপান্তরিত করে। এই কৌশলটি সামরিক প্রচারণার একটি ক্লাসিক উদাহরণ, যেখানে মিডিয়া রাষ্ট্রের একটি অপারেশনাল শাখায় পরিণত হয়।
ইসলামোফোবিয়া ও ওরিয়েন্টালিজম
পশ্চিমা মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বের মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি হলো ইসলামোফোবিয়া, যা মুসলিম পরিচয়কে স্বাভাবিকভাবেই সহিংস, অসভ্য ও বর্বর হিসেবে চিত্রিত করে। এই চিত্রায়ণটি এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘প্রাচ্যবাদ’ বা ওরিয়েন্টালিজম তত্ত্বে সবিস্তারে বিশ্লেষণ করেছেন।
‘বিপজ্জনক অপর’-এর নির্মাণ
সাঈদ তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে পশ্চিম নিজেদের যুক্তিবাদী, নৈতিক ও সভ্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ‘প্রাচ্য’ তথা আরব ও মুসলিমদের অযৌক্তিক, নৈতিকভাবে ভ্রষ্ট ও বিপজ্জনক ‘অপর’ হিসেবে নির্মাণ করেছে। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি কমাতে মিডিয়াকে সরাসরি সাহায্য করে।
দীপা কুমার তার গ্রন্থ ‘ইসলামোফোবিয়া অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব এম্পায়ার’-এ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, ইসলামোফোবিয়া হলো সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতির এক অপরিহার্য হাতিয়ার, যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেয়। গাজা কভারেজে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে উপেক্ষা করা বা লঘু করা (যেমনÑনুসেইরাত হত্যাকাণ্ডে ২৭৪ জনের মৃত্যুর চেয়ে চার ইসরায়েলি বন্দির উদ্ধারকে প্রধান করা) এই কাঠামোরই অংশ। যদি ফিলিস্তিনিরা ‘বিপজ্জনক অপর’ হয়, তবে তাদের মৃত্যু কেবল ‘পার্শ্বক্ষতি’ মাত্র, যা ইসরায়েলি ‘সভ্য’ মিশনের জন্য অপরিহার্য।
শৈশবের অমানবিকীকরণ
ফিলিস্তিনি শিশুদের বর্ণনা করতে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (মাইনর) বা ‘কিশোর’ (টিনএজার) শব্দ ব্যবহার এবং ইসরায়েলিদের জন্য ‘শিশু’ শব্দ ব্যবহারের কৌশলটি ইসলামোফোবিয়ার সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও জঘন্য বহিঃপ্রকাশ। ‘শিশু’ শব্দটি দ্বারা শৈশবের সারল্য এবং নিরীহতা বোঝায়, যা পাঠকের মনে গভীর সহানুভূতি তৈরি করে। ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ‘কিশোর’ শব্দটি আইনি বা মনস্তাত্ত্বিক বয়সের সীমাকে ইঙ্গিত করলেও তা নিরীহতার ধারণা সরিয়ে দেয়। এই ভাষাগত পরিবর্তন ফিলিস্তিনি শিশুদের থেকে তাদের ‘শৈশবের মর্যাদা’ ছিনিয়ে নেয়।
ইসলামোফোবিক কাঠামো যুক্তি দেয় যে, মুসলিম শিশুরা, বিশেষত যারা প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত, তারা তাদের পরিবেশে ‘সন্ত্রাস’ দ্বারা দূষিত। তাই তাদের শৈশব ইসরায়েলি শিশুদের মতো ‘পবিত্র’ নয় এবং তারা কম সহানুভূতির যোগ্য। এটি ইসরায়েলকে শিশু আটককারী রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো এড়ানোর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর একটি কৌশল।
‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’-এর বিতর্কিত ব্যবহার
ডয়চে ভেলের মতো আউটলেটে জার্মান পুলিশের তথ্য ছাড়াই একটি হুমকির উৎসকে ‘ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করা ইসলামোফোবিয়ার সরাসরি প্রমাণ। এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘কাভারিং ইসলাম’ গ্রন্থে মিডিয়ার মুসলিম বিশ্বকে কাভার করার পক্ষপাতদুষ্ট পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মিডিয়া মুসলিমদের একটি মনোলিথিক অর্থাৎ একরৈখিক এবং নেতিবাচক রূপে উপস্থাপন করে। একটি বিচ্ছিন্ন হুমকির জন্য ‘ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে মিডিয়া পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর সন্দেহের বোঝা চাপায়, যা জার্মানিতে জর্দানীয় ছাত্র মোহাম্মদ বারাকাত হত্যার মতো ঘটনায় ঘৃণ অপরাধ (হেইট ক্রাইম) বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
উপনিবেশের বৈধতা
পশ্চিমা মিডিয়ার কভারেজের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো সংঘাতের মূল প্রেক্ষাপট, অর্থাৎ ইসরায়েলি দখলদারিকে উপেক্ষা করা। এই প্রেক্ষাপট অপসারণ ‘ওয়ার অন টেরর’ এবং ইসলামোফোবিয়ার ফ্রেমকে শক্তিশালী করে।
দখলদারত্বের উপেক্ষা এবং ‘যুদ্ধ’ হিসেবে চিত্রায়ণ
পশ্চিমা মিডিয়া গণহত্যাকে ‘ইসরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধ’ হিসেবে চিত্রিত করে, যা দখলদার শক্তি এবং দখলীকৃত জনগণের মধ্যকার আইনি পার্থক্যকে মুছে দেয়। জন জে মিয়ারশাইমার এবং স্টিফেন এম ওয়াল্ট তাদের প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘দ্য ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি’তে দেখিয়েছেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এবং নীতিনির্ধারণী মহলে ইসরায়েলের স্বার্থকে নজিরবিহীনভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই লবিংয়ের প্রভাবে পশ্চিমা মিডিয়া দখলদারির মূল সত্যকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের ‘নিরাপত্তা’ আখ্যানকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘ কর্তৃক ইসরায়েলকে ‘দখলদার শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও মিডিয়া এই সত্যকে নিয়মিত উপেক্ষা করে। লে ফিগারোর ‘ক্রসফায়ার’ আখ্যান বা দ্য ইকোনমিস্টের হাসপাতাল আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা-এসবই ইসরায়েলকে কেবল ‘নিরাপত্তা প্রয়াসী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করে, যার সামরিক পদক্ষেপগুলো ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অধীনে বৈধ।
সাংবাদিকতার পেশাগত নীতি হলো সব পক্ষের তথ্য যাচাই করা; কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া সচেতনভাবে ইসরায়েলি আখ্যানকে প্রশ্ন করা তথ্যকে দমন করেছে। ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজর মতো উৎস থেকে আসা তথ্য (ইসরায়েলি হেলিকপ্টার কর্তৃক নিজেদের নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার খবর) পশ্চিমা মিডিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ইসরায়েলি হামলায় আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল শরীফের নিহত হওয়ার কভারেজেও ইসরায়েলের অপ্রমাণিত অভিযোগÑতিনি ‘হামাস সেলের প্রধান’ ছিলেন তা যুক্ত করে। এই কৌশলটি ইসলামোফোবিক ধারণার ওপর নির্ভর করে। যেখানে একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের পেশাগত পরিচয় সন্দেহের যোগ্য, কারণ তিনি জাতিগতভাবে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ধারণার সঙ্গে যুক্ত। এই সন্দেহ যুক্ত করার মাধ্যমে তার হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে নৈতিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের নৈতিক দেউলিয়াপনা
গাজা কভারেজ পশ্চিমা মিডিয়াকে তাদের নৈতিক মানদণ্ডের চরম পতনের দিকে নিয়ে গেছে। তাদের ব্যর্থতাগুলো কেবল সাংবাদিকতার অসংগতি নয়; বরং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারের অভাবকেও নির্দেশ করে।
দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনে গ্রেম উডের মতো প্রখ্যাত লেখকদের প্রবন্ধ, যেখানে শিশুদের হত্যাকে ‘পার্শ্বক্ষতি’ বা কোলাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তা পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর নৈতিক দেউলিয়াপনার চূড়ান্ত উদাহরণ। এই ধরনের বিশ্লেষণ ‘ওয়ার অন টেরর’-এর কাঠামো ব্যবহার করে। যদি হামাস শিশুদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে, তবে শিশুরা তাদের ‘নিরীহতার সুরক্ষা’ হারায় এবং তাদের মৃত্যু নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এই যুক্তিটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিকতার মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি কার্টুনও একই ইসলামোফোবিক আখ্যানের প্রচার করে-মুসলিমরা নিজেরাই তাদের শিশুদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত
নোয়াম চমস্কি তার ‘প্রোপাগান্ডা মডেল’-এ যেমন দেখিয়েছিলেন, মিডিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ কীভাবে সংবাদকে প্রভাবিত করে। ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক জেফ বেজোসের ইসরায়েলে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিষয়টি সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের ওপর করপোরেট স্বার্থের সম্ভাব্য প্রভাবের প্রশ্ন তোলে। মিয়ারশাইমার এবং ওয়াল্টের তত্ত্ব অনুসারে এ ধরনের অর্থনৈতিক ও লবিংয়ের স্বার্থ ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর গাজা কভারেজের বিশ্লেষণ প্রমাণ করে, সাংবাদিকতা যখন ‘ওয়ার অন টেরর’ এবং ‘ইসলামোফোবিয়া’র মতো শক্তিশালী জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তার নৈতিকতা নিশ্চিতভাবেই লঙ্ঘিত হয়। এই কাঠামো ফিলিস্তিনিদের মানবিক পরিচিতি হরণ করে, তাদের প্রতিরোধকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে চিত্রিত করে এবং দখলদারির প্রসঙ্গকে মুছে ফেলে।
এডওয়ার্ড সাঈদ যেমনটি বলতেন, ‘সংবাদ লেখা কেবল একটি ভাষা নয়, একটি যুদ্ধক্ষেত্রও বটে।’ পশ্চিমা মিডিয়া এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতার ভান করে ইসরায়েলের পক্ষে লড়াই করেছে ও করছে। তাদের এই পক্ষপাতিত্ব মানবিক বিপর্যয়কে দীর্ঘায়িত করতে এবং আন্তর্জাতিক জবাবদিহিকে অচল করে দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। সাংবাদিকতার এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো আখ্যানকে উপনিবেশমুক্ত করা, পশ্চিমা আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং ফিলিস্তিনিদের জীবনকে তাদের আইনি ও মানবিক প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরা। যতদিন না এই কাঠামোগত পক্ষপাত দূর হবে, ততদিন পশ্চিমা মিডিয়া কেবল সত্যের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হবে না; বরং তারা নিজেরাই ঐতিহাসিক অন্যায়ের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হবে।
