Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা যুদ্ধের আখ্যান প্রশ্নের মুখে

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩৭

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা যুদ্ধের আখ্যান প্রশ্নের মুখে

গত দুই মাসে মার্কিন সামরিক বাহিনী ক্যারিবীয় অঞ্চলে তাদের উল্লেখযোগ্য নৌ ও বিমানবাহিনীর উপস্থিতির মাধ্যমে অন্তত সাতটি নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন স্বীকার করেছে, এই হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছে, যাদের তারা ‘মাদক সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই নিহতরা মাদক পাচারের জন্য নৌকাগুলো ব্যবহার করছিল। এ পর্যন্ত প্রশাসন নৌকাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং ডুবিয়ে দেওয়ার যত ঘোষণা দিয়েছে, তাতে সব নৌকাকে ভেনেজুয়েলার বলে দাবি করা হয় এবং বলা হয় যে এদের যাত্রা শুরু হয়েছে ভেনেজুয়েলা থেকে।

এটি বর্তমানে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে ঘিরে থাকা দুটি পৃথক কিন্তু সম্পর্কিত আখ্যানকে তুলে ধরে-প্রথমত,  ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিমা গোলার্ধে সক্রিয় মাদক কার্টেলগুলোর সঙ্গে যুদ্ধরত হিসেবে তুলে ধরে। প্রেসিডেন্ট এবং তার ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টারা বিশ্বাস করেন, এই যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগকে ন্যায্য করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চান এবং আপাতত তিনি সফলভাবে ট্রাম্প এবং প্রশাসনের বাকিদের তার শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডাকে সমর্থন করতে রাজি করিয়েছেন, যার আংশিক ভিত্তি হলো এই মাদকবিরোধী অভিযানের আখ্যান।

প্রশাসনের বক্তৃতায় এই দুটি গল্প যেভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, তাতে এদের গুলিয়ে ফেলা খুবই স্বাভাবিক। ট্রাম্প এবং তার সহকারীরা ক্রমাগত মাদুরোকে একটি মাদক কার্টেল, কার্টেল অব দ্য সানসের প্রধান হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যাকে প্রশাসন একটি বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেও মনোনীত করেছে।

যখনই মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে ভেনেজুয়েলায় শাসন পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তারা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে মাদুরো কীভাবে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে সরাসরি মাদক পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। অক্টোবরের শুরুতে প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞপ্তিতে মাদক চোরাচালানের সন্দেহে নিহত ব্যক্তিদের ‘বেআইনি যোদ্ধা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কংগ্রেসকে দেওয়া এই বিজ্ঞপ্তিতে গ্রেপ্তারের বদলে হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে এক দুর্বল অজুহাত পেশ করা হয়। এটি পূর্বেকার প্রশাসনগুলোর দ্বারা নির্বাহী যুদ্ধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত সেই পুরোনো, অস্পষ্ট যুক্তিরই প্রতিধ্বনি-‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বন্ধুত্বপূর্ণ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর নাগরিক ও স্বার্থের বিরুদ্ধে এই শত্রুতামূলক কাজগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ভিত্তিতে, প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতে রয়েছে।’ তাদের দাবি ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ‘একটি নাজুক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, যেখানে এই মনোনীত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চলমান আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা এবং অন্যদের প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের বলপ্রয়োগ করতেই হবে।’ এই নথিটি মাদক কার্টেলগুলোর মোকাবিলায় অসাধারণ যুদ্ধকালীন ক্ষমতা প্রয়োগের এক ধরনের স্ব-আরোপণ ছিল, যা অবৈধ মাদক পাচারকে মার্কিন নাগরিকদের ওপর সশস্ত্র হামলার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করে। 

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সংখ্যা মোটেই নগণ্য নয়। মাইকেল স্মিট ‘জাস্ট সিকিউরিটি’তে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে স্পষ্ট হলো-একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বাস্তবিক লঙ্ঘন, যা আইন প্রয়োগের মতো তার ‘স্বাভাবিকভাবে সরকার সম্পর্কিত কার্যক্রমে’ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ঘটতে পারে। অন্য একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া তার আন্তর্জাতিক বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের সমতুল্য হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বলপ্রয়োগ করা বেআইনি, যা জাতিসংঘের সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ এবং প্রথাগত আইন লঙ্ঘন করে। 

এই সাজানো পরিকল্পনায় কিছুই যুক্তিসংগত হয়নি। যদি উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রে মাদক ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় মৃত্যুর হার কমানো হয়, তবে ফেন্টানিলের প্রবাহ হতো এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ফেন্টানিল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নয়, বরং মেক্সিকো থেকে আসে। আসলে বৃহত্তর উদ্দেশ্যটি আরো ঐতিহ্যবাহী। আমেরিকায় ওয়াশিংটনের স্বার্থের প্রতি অবন্ধুত্বপূর্ণ বিবেচিত সরকারগুলোকে অপসারণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মাদক এখন একটি উত্তেজক অজুহাতে পরিণত হয়েছে।  ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে মাদক পাচারকারী সংস্থা কার্টেল অব দ্য সানসের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়াও তাকে ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’ কারাগারের গ্যাংয়ের অন্ধকার কার্যকলাপ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অনিয়মিত যুদ্ধ’ পরিচালনারও অভিযুক্ত করা হয়। 

যদিও গোয়েন্দারা এর বিপরীতে দাবি করে, এই গ্যাং মাদুরোর নিয়ন্ত্রণে নেই। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের প্রাথমিক গোয়েন্দা মূল্যায়ন পুনর্বিবেচনা করার পরই এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মাইকেল কলিন্সকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

২০২০ সালে, প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরোর গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্ত করার তথ্যের জন্য ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর আরো দুইবার পুরস্কারের অঙ্ক বাড়ানো হয়, যার মধ্যে সর্বশেষটি ছিল ৭ আগস্ট, কার্টেল অব দ্য সানসকে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারি দ্বারা বিশেষভাবে মনোনীত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের পুরস্কার বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করে, ‘কার্টেল অব দ্য সানসের নেতা হিসেবে মাদুরো হলেন নারকোটিক্স রিওয়ার্ডস প্রোগ্রামের ইতিহাসে ২৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি পুরস্কারের প্রথম লক্ষ্য।’

ট্রাম্প তার অকপট মুহূর্তগুলোর একটিতে স্বীকার করেন, একটি প্রেসিডেনশিয়াল ফাইন্ডিংয়ের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে (সিআইএ) ভেনেজুয়েলার মাটিতে এবং বৃহত্তর ক্যারিবীয় অঞ্চলজুড়ে গোপন প্রাণঘাতী অভিযান পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গোপন অনুমোদনের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন অবশ্যই স্থলভাগের দিকেও নজর দিচ্ছি, কারণ সমুদ্র আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ নিজের দুর্বল আখ্যান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার ‘তাদের কারাগার থেকে লোকজনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া’ এবং মাদকের বিষয়টি উল্লেখ করেন।

এই অনুমোদনের পাশাপাশি ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। সেখানে আটটি যুদ্ধজাহাজ এবং একটি সাবমেরিন, পুয়ের্তো রিকোর ঘাঁটিতে থাকা প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা এবং উভচর সামরিক নৌকাসহ মেরিনদের একটি কন্টিনজেন্ট। এদিকে সম্প্রতি বিতর্কিত নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিজয়ী, ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে শক্তিশালী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনায় উচ্ছ্বসিত। ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে আর হোয়াইট হাউসের স্বঘোষিত শান্তি স্থাপনকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫