ইসরায়েলি আটককেন্দ্র থেকে ফেরত এসেছে ১৩৫ বিকৃত মরদেহ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি জেলে কমপক্ষে ৭৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা আটক কেন্দ্রের পরিবেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বন্দিদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতন হয়েছে।
ইসরায়েলি মানবাধিকার গোষ্ঠী বিতসেলেম আগস্টের এক প্রতিবেদনে ইসরায়েলি কারাগারব্যবস্থাকে ‘নির্যাতন শিবিরের নেটওয়ার্ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে বন্দিদের প্রতি অপব্যবহার একটি ‘নীতিগত বিষয়ে’ পরিণত। এই নেটওয়ার্কের মধ্যে কুখ্যাত ‘সদে তেইমান আটককেন্দ্র’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ।
জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা আটককেন্দ্রে ব্যাপক অপব্যবহারের খবর পেয়েছেন, যা অমানবিক ও নৃশংস অবস্থার প্রমাণ দেয়। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নির্যাতনের অসংখ্য পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে
রয়েছে-
* বন্দিদের খাঁচার মতো ঘরে রাখা, চোখ বাঁধা, ডায়াপার পরিয়ে বিছানায় বেঁধে রাখা।
* যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা, কুকুরের আক্রমণ এবং সিগারেটের পোড়া দাগ।
* পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য, জল এবং ঘুম থেকে বঞ্চিত করা।
* মানসিক নির্যাতন, যেমন-উচ্চ শব্দে গান বাজানো এবং পরিবারের সদস্যরা মারা গেছে বলে মিথ্যা তথ্য দেওয়া।
গুরুতর আঘাত ও দুর্বলতার কারণে মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক বন্দিকে সরাসরি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হয়েছে। মাহমুদ আবু ফুল, একজন মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি, যিনি ইসরায়েলি নির্যাতনের ফলে তার দৃষ্টিশক্তি হারানোর কথা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির, যিনি কারাগার পরিষেবার দায়িত্বে আছেন, প্রকাশ্যে এই নির্যাতনকে সমর্থন করেছেন।
এই ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন বন্দিদের ওপর নিপীড়নকে কেবল ব্যক্তিগত অপব্যবহারের ঘটনা হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্র-অনুমোদিত নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
বন্দিদের ওপর যৌন সহিংসতার অভিযোগ বিশেষ উদ্বেগের কারণ। গত বছর ‘সদে তেইমান আটককেন্দ্রে’ এক ফিলিস্তিনি বন্দির সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ‘বর্তমানে ইসরায়েলি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দ্বারাও সমর্থন লাভ করেছে’, যা প্রমাণ করে যে, নৈতিক দিকনির্দেশনা হারিয়ে গেছে। যৌন সহিংসতাকে পদ্ধতিগতভাবে অপমান এবং অবমাননার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কেবল ভিকটিমের ওপর নয়; বরং সমগ্র ফিলিস্তিনি সমাজের ওপর আঘাত হানছে।
এই ব্যাপক নির্যাতনের সাক্ষ্যপ্রমাণ, যা বিভিন্ন বন্দির কাছ থেকে এসেছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই দাবিকে সরাসরি অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, তারা আটককৃতদের ‘যথাযথ ও যত্ন সহকারে’ আচরণ করে এবং অসদাচরণের অভিযোগগুলো তদন্ত করা হয়। তবে বোঝা যায়, অভ্যন্তরীণ এই তদন্তগুলো আসলে অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য নয়; বরং দায়মুক্তি নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়ামাত্র।
ইসরায়েলি হেফাজতে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মৃত্যুর পর তাদের মরদেহ গাজায় ফেরত দেওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের (আইএইচএল) গুরুতর লঙ্ঘনের ইঙ্গিত বহন করে। ইসরায়েল কর্তৃক ফেরত দেওয়া ১০০ জনেরও বেশি মৃত ফিলিস্তিনির অধিকাংশই অশনাক্ত ছিল। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা ফেরত দেওয়া মরদেহগুলোর ভয়াবহ অবস্থার নিন্দা জানিয়েছেন। এই মরদেহগুলো তিনটি ব্যাচে ফেরত দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনদের শনাক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে মরদেহগুলোর ছবি দেখতে বাধ্য হয়।
চিকিৎসা সূত্র এবং ফরেনসিক দলগুলোর পরীক্ষা থেকে নিশ্চিত হয়েছে যে মরদেহগুলোতে মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। এই চিহ্নগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
*চোখ-বাঁধা কাপড় ও হাতকড়া, যা প্রমাণ করে মৃত্যুর আগে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল।
* অধিকাংশ দেহাবশেষ ‘পশুর মতো বাঁধা, চোখ বাঁধা’ এবং গুরুতর নির্যাতন ও পোড়ানোর চিহ্ন বহন করছিল।
* ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর জানিয়েছে, মরদেহগুলোতে ফাঁসি দেওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন, গলায় দড়ির ছাপ, একেবারে কাছ থেকে গুলির আঘাত এবং প্লাস্টিকের বাঁধন দিয়ে বাঁধা হাত-পা ছিল।
* কিছু মরদেহে ট্যাংক দ্বারা পিষে ফেলার চিহ্ন, হাড় ভাঙা এবং গভীর ক্ষতের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুরশ নিশ্চিত করেছেন, বন্দিরা ‘স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি-ভয়াবহ অবস্থায় তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।’ তিনি এই ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করে জরুরি আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। কিছু মরদেহ মাসখানেক ধরে ‘দখলদারিত্বের ফ্রিজে রাখা হয়েছিল’ বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মরদেহগুলোকে নাম বা শনাক্তকরণ তথ্য ছাড়াই ফেরত দেওয়া, পরিবর্তে শুধু সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা-এই প্রক্রিয়াটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটি অন্যতম ইঙ্গিত দেয়। পদ্ধতিগতভাবে পরিচয় অস্বীকারের ফলে পরিবারগুলো মৃতদেহের মর্মান্তিক, বিকৃত ছবি দেখতে বাধ্য হয়, যা শোককে দীর্ঘায়িত করে এবং বেঁচে থাকাদের ওপর চরম মানসিক নির্যাতন চাপিয়ে দেয়। এটি ন্যায়বিচার ও সঠিক ফরেনসিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করারও একটি কৌশল।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো অঙ্গ চুরির সন্দেহ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কিছু মরদেহে অঙ্গ বা দাঁত অনুপস্থিত ছিল, আবার কিছু মরদেহ পোড়ানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের মহাপরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতা বলেন, ‘যখন আমরা মরদেহগুলো পরীক্ষা করেছিলাম, তখন দেখতে পেলাম, শরীরের বড় অংশ অনুপস্থিত। সেখানে অর্ধেক শরীর, মাথা ছাড়া, অঙ্গ ছাড়া, চোখ ছাড়া এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ছাড়া মরদেহ ছিল।’
ইউরো-মেড মনিটরের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, গাজার চিকিৎসা পেশাজীবীরা দ্রুত পরীক্ষার পর অঙ্গ চুরির প্রমাণ পেয়েছেন, যেখানে মরদেহের মধ্যে কর্নিয়া, কক্লিয়া, লিভার, কিডনি ও হার্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অনুপস্থিত ছিল। যদিও ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, এই ধরনের শারীরিক প্রমাণের উপস্থিতি আইএইচএলের গুরুতর লঙ্ঘন, বিশেষত মরদেহের প্রতি এমন আচরণ ‘গণহত্যামূলক অভিপ্রায়ের’ জোরালো সূচক। এই গুরুতর অভিযোগগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করতে একটি জরুরি, স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফরেনসিক তদন্ত প্রয়োজন।
ঔপনিবেশিক আইন ও কারাগার
প্রশাসনিক আটকাদেশ হলো একটি পদ্ধতি, যার অধীনে ফিলিস্তিনিদের কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়। বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি জেলে রয়েছেন, যার মধ্যে ৫২ জন নারী এবং প্রায় ৪০০ শিশু। অন্তত তিন হাজার ৫০০ লোক প্রশাসনিক আটকাদেশের অধীনে রয়েছে। সংখ্যাটি এই আইনের ব্যবহার বৃদ্ধির একটি ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ সীমা নির্দেশ করে। এই ব্যবস্থার অধীনে আটকাদেশ সামরিক কমান্ডারদের দ্বারা জারি করা হয় এবং তা কার্যত অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় আইনি ত্রুটি হলো, আটককৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা গোপন প্রমাণ বা অভিযোগের বিশদ বিবরণ তাদের বা তাদের আইনজীবীদের কাছে প্রকাশ করা হয় না।
২০০২ সালে প্রণীত ‘বেআইনি যোদ্ধা’ আইনটি এমন ব্যক্তিদের আটকে রাখার জন্য তৈরি করা হয়, যারা সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য হলেও ‘যুদ্ধবন্দি’ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নন। এই আইনটি কার্যকরভাবে আইনি ফাঁক তৈরি করে, যার ফলে গাজা থেকে আটক করা শত শত লোককে কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। আংশিক হিসাব অনুযায়ী, দুই হাজার ৬৭৩ ব্যক্তিকে এই আইনের অধীনে আটক করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন, আইএইচএলের অধীনে ‘বেআইনি যোদ্ধা’-এর কোনো সুস্পষ্ট মধ্যবর্তী মর্যাদা নেই, যা যুদ্ধবন্দি বা সুরক্ষিত বেসামরিক নাগরিক (জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ ধারা) উভয় সুরক্ষাই বাতিল করতে পারে। এই আইনের অধীনে, আটককারী কর্তৃপক্ষ প্রমাণ করার দায়িত্ব বন্দির ওপর চাপিয়ে দেয় যে সে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, গোপন তথ্যের কারণে যা করা প্রায় অসম্ভব।
বেআইনি যোদ্ধা আইনের অধীনে একটি গুরুতর আইনি প্রভাব হলো ইনকমিউনিকেডো ডিটেনশনের (যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আটক) সুযোগ। যখন গাজার হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে চার্জ ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে এবং পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় গোপন সামরিক ক্যাম্পে আটকে রাখা হয় (যেমন-সদে তেইমান), তখন এই পদ্ধতি বলপূর্বক গুমের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই আইনি কাঠামো বিচারবহির্ভূত পদ্ধতি এবং নির্যাতনকে আড়াল করার জন্য একটি আবরণ তৈরি করে।
এই পুরো কারাবাস ব্যবস্থাটিকে কেবল একটি বিচারিকপ্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত নয়; বরং সামরিক দখলদারির একটি মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে দেখা উচিত। এই ‘কারাবাসের রাষ্ট্র’ (Carceral State) ফিলিস্তিনিদের দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত তাড়া করে। এর উদ্দেশ্য কেবল অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া নয়; বরং পুরো সমাজকে শৃঙ্খলিত করা, রাজনৈতিক প্রতিরোধ সত্তাকে চূর্ণ করা এবং ফিলিস্তিনিদের সময় ও জীবনকেই উপনিবেশিত করা। প্রায় প্রতিটি পরিবারই রাতে বাড়িতে সামরিক অভিযানের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, যা দেখায় কারাগারের যন্ত্রণা দেওয়াল দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।
আটককৃতদের ‘বন্দি’ বলা হয়, যেখানে ইসরায়েলিদের ‘জিম্মি’ বলা হয়। এই ভাষার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। একটি শব্দ অভিযোগ বহন করে, অন্যটি নিষ্পাপতা ও সহানুভূতি জাগায়। বাস্তবতা হলো, সব ফিলিস্তিনিই দখলদারিত্ব, অবরোধ এবং আত্মপরিচয় চূর্ণ করার জন্য তৈরি একটি কারাবাস ব্যবস্থার শিকার।
