Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

জন্ম পাকিস্তানে, তবুও ‘অবৈধ বিদেশি’

Icon

মো. ইমরানুর রহমান

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:২৪

জন্ম পাকিস্তানে, তবুও ‘অবৈধ বিদেশি’

আল্লাহ মীরের মা-বাবা ছিলেন সেই লক্ষাধিক আফগানের একজন, যারা ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পর আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তাদের পরিবার 

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটের একটি শরণার্থী গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখানেই জন্ম আল্লাহ মীরের, যিনি এখন ৪৫ বছর বয়সী। 

মীর জানান, তার বৃহৎ আত্মীয়-পরিবারের দুই শতাধিক সদস্য আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। গত দুই বছর ধরে পাকিস্তান হাজার হাজার আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তখন থেকেই তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক ঘিরে আছে। গত সপ্তাহে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, তারা দেশের মোট ৫৪টি আফগান শরণার্থী গ্রাম বন্ধ করে দেবে। এর মধ্যে কোহাটের গ্রামগুলোও রয়েছে, যেখানে মীরের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাস করছে।

মীর বলেন, ‘আমার জীবনে আমি একবারই আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। এর বাইরে আমার পরিবারের কেউ কখনো ফিরে যায়নি। আমরা এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, বিয়ে করেছি, আমাদের প্রিয়জনদের এখানেই কবর দিয়েছি-এখন কীভাবে সব কিছু উপড়ে ফেলব?’ ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পাকিস্তান ও তালেবান সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হয়ে উঠেছে। সেই টানাপড়েনের মাঝে মীরের মতো পরিবারগুলো এখন অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে আটকে পড়েছে। অক্টোবরের শুরুতে আফগান ও পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে প্রকাশ্য শত্রুতায় পরিণত করে।

১৯ অক্টোবর কাতারের রাজধানী দোহায় দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছেন। তবুও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। মীরের মতো হাজারও পরিবার আশঙ্কা করছে, তারা হয়তো দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত-সংঘাতের কূটনৈতিক বলি হয়ে পড়বে।

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর থেকে পাকিস্তান লাখ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এবং ১৯৯৬ সালে তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসার পর আরো বহু আফগান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে হামলার পর তালেবানের পতনে কিছু আফগান স্বদেশে ফিরে যায়। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের হঠাৎ পুনরুত্থানের পর আবারও বিশাল অভিবাসন ঘটে। তখন ছয় থেকে আট লাখ আফগান পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। তবে গত চার বছরে কাবুল ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক ক্রমে তিক্ত হতে থাকে। একসময় তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে অভিযুক্ত করতে শুরু করে। এর পর থেকে পাকিস্তানের নীতিতে কঠোরতা বেড়েছে। এমনকি তাদের প্রতিও যারা বহু দশক ধরে দেশটিতে বসবাস করছে-যেমন মীরের পরিবার। 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ২০০৬ সাল থেকে পাকিস্তানে অবস্থানরত আফগান নাগরিকদের জন্য প্রুফ অব রেজিস্ট্রেশন (পিওআর) নামের পরিচয়পত্র দিচ্ছে। এই কার্ডের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানে আইনগতভাবে থাকতে পারতেন, সীমিত চলাচলের স্বাধীনতা ও কিছু সরকারি সেবা-যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জুনের পর পাকিস্তান সরকার আর এসব কার্ড নবায়ন করেনি এবং আগের কার্ডগুলোও বাতিল ঘোষণা করেছে। ২০১৭ সালে পাকিস্তান আফগান সিটিজেন কার্ড (এসিসি) নামে আরেক ধরনের পরিচয়পত্র চালু করেছিল, যাতে অনথিভুক্ত আফগানদের সাময়িক আইনি মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু এখন সেটিও আর নির্বাসন থেকে রক্ষা করতে পারছে না।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শুরু হওয়া অভিযান থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ আফগান পাকিস্তান ছেড়েছে। ইউএনএইচসিআরের পাকিস্তান মুখপাত্র কায়সার খান আফ্রিদি জানান, এখনো পাকিস্তানে প্রায় ১২ লাখ পিওআর কার্ডধারী, সাত লাখ ৩৭ হাজার এসিসি ধারক এবং এক লাখ ১৫ হাজার আশ্রয়প্রার্থী অবস্থান করছে। তিনি বলেন, ‘৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তান অসাধারণ উদারতার সঙ্গে লাখ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এখন সরকারের যে সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে শরণার্থী গ্রামগুলো বাতিল ঘোষণা করে ফেরত পাঠানো শুরু করা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

মীর বহু বছর ধরে ইউএনএইচসিআরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি জানান, শুধু কোহাট অঞ্চলের সাতটি শরণার্থী গ্রামেই এক লাখেরও বেশি মানুষ বাস করেন। তার মতে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয় দেশই শরণার্থী ইস্যুটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে পিওআর কার্ড অবৈধ হয়ে যাওয়ায় মীর এখন কোনো স্বীকৃত পরিচয়পত্র ছাড়াই বসবাস করছেন। ফলে নিজের সন্তানরা অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবাও পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, “বাস্তবে আমরা এখন সেই দেশে ‘অবৈধ বিদেশি’, যাকে আমি ও আমার সন্তানরা নিজেদের বাড়ি বলে জানি।”

২০২৩ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান আফগানদের বহিষ্কার অভিযান শুরু করে, যা বাড়তে থাকা বিদ্রোহী হামলার অজুহাতে পরিচালিত হয়। এর পর থেকে সহিংসতা বেড়েছে আর ২০২৫ সাল হয়ে উঠছে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে সহিংস বছর। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দাবি, আফগান শরণার্থীরা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে আর তালেবান সরকার সীমান্তপারের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে, যা কাবুল অস্বীকার করেছে। দুই বছর আগে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগটি অভিযোগ করেছিলেন, ২০২৩ সালে দেশে সংঘটিত ২৪টি আত্মঘাতী হামলার মধ্যে ১৪টিই নাকি আফগান নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত। তবে তিনি কোনো প্রমাণ দেননি। হামলাকারীরা পাকিস্তানে বসবাসরত শরণার্থী ছিলেন নাকি সীমান্ত পেরিয়ে আসা যোদ্ধা, সেটাও স্পষ্ট করেননি।

তবে মীরের আশঙ্কা, আফগানিস্তানে ফিরে গেলেও তাদের প্রতি অবিশ্বাস থাকবে। তিনি বলেন, ‘ওখানে আমাদের পাকিস্তানি বলে দেখা হবে, শত্রু হিসেবেই গণ্য করা হবে।’

ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র আফ্রিদি পাকিস্তান সরকারকে এই বহিষ্কার অভিযান পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে এমন আফগানদের জোরপূর্বক ফেরত না পাঠানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাই। পাকিস্তানের শরণার্থী আতিথেয়তার ইতিহাস গর্বের বিষয়। এই সংকটময় সময়ে সেই ঐতিহ্য বজায় রাখা জরুরি।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫