Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

এল-ফাশের : গণহত্যার নীরব সাক্ষী

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩৯

এল-ফাশের : গণহত্যার নীরব সাক্ষী

সুদানের দারফুর অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত একটি পরিবার ছবি : এএফপি

সুদানের আধা-সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) হাতে এল-ফাশের শহর পতনের পর সেখানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ আটকা পড়ে। অনেকেই আরএসএফ যোদ্ধাদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভয়ে আত্মগোপন করে আছে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই ভয়াবহ গণহত্যার চিত্র।

‘কোনো দয়া নেই’

দারফুর অঞ্চলে সেনাবাহিনীর শেষ শক্ত ঘাঁটি ছিল এই এল-ফাশের। গত ২৬ অক্টোবর শহরটির পতন হয়। সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের ভাষ্য মতে, রক্তপাত এড়াতে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের সৈন্যদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আলোচনা করে। তবে সেনা সদস্যদের এই প্রত্যাহারের ফলে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত ও বিপর্যস্ত বেসামরিক নাগরিক-একাকী আরএসএফের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়।

আবুবকর আহমেদ সুদানে আড়াই বছরের গৃহযুদ্ধে এল-ফাশের শহরকে আরএসএফের হাত থেকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তায় গঠিত ‘পপুলার রেজিস্ট্যান্স’ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ৫৫০ দিন ধরে লড়াই করেছেন। তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ২৯ বছর বয়সী আবুবকর জানান, চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় একটি রকেটচালিত গ্রেনেড নিকটবর্তী একটি গাড়িতে আঘাত হানলে তার পেটে স্প্লিন্টার লাগে। অল্প কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি গুলি চালাতে চালাতে শহর থেকে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অনেকেই পারেননি। পালিয়ে আসার পর তিনি বলেন, ‘আরএসএফ বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছে এবং তাদের মরদেহ রাস্তায় ফেলে রেখেছে। তাদের কোনো দয়া নেই।’

জাতিগত নিধন

এল-ফাশের দখলের প্রথম তিন দিনে আরএসএফের হাতে কমপক্ষে দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে স্থানীয় সংস্থা সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে। নিহতদের মধ্যে স্থানীয় আল-সৌদ হাসপাতালের ৪৬০ জন রোগী এবং তাদের সঙ্গী অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারাও যাচাই করা হয়েছে। আলজাজিরার নিজস্ব যাচাইকরণ ইউনিট, সানাদ, বেশ কিছু ভিডিও প্রমাণ হিসেবে পেয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে-আরএসএফ সৈন্যরা মৃতদেহের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বা সারিবদ্ধ নিরস্ত্র যুবকদের গুলি করে হত্যা করছে।

এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ফলে ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষ এরই মধ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও শহরে পালিয়ে গেছে, যা এল-ফাশের থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তবে বেশির ভাগ বেসামরিক নাগরিক এখনো আরএসএফ বন্দুকধারীদের ভয়ে এল-ফাশেরে লুকিয়ে আছে। বেঁচে ফেরাদের একজন মোহাম্মদ, যিনি ২৮ অক্টোবর পাশের শহর তাওইলায় পৌঁছান। তিনি জানান, আরো কয়েক হাজার মানুষের আগমনের প্রত্যাশা করছেন। 

এল-ফাশেরের অধিকাংশ বাসিন্দার মতো মোহাম্মদও সেখানকার স্থায়ী ‘অ-আরব’ জনগোষ্ঠীর একজন, যারা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর ‘আরব’ জনগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হয়ে এসেছে। আরএসএফের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও ওই যাযাবর জনগোষ্ঠী।

মোহাম্মদ বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষ আরএসএফের ভয়ে এল-ফাশেরে থাকবে না। তারা আরএসএফকে বিশ্বাস করে না, কারণ তারা জানে যে তাদের ওপর অত্যাচার করা হবে। আরবরা এক জায়গায় থাকবে আর অ-আরবরা অন্য জায়গায়। দুর্ভাগ্যবশত, এখন এমনই পরিস্থিতি।’

রুয়ান্ডার প্রতিধ্বনি

বেঁচে ফেরা মানুষ এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, এল-ফাশেরের এই হত্যাকাণ্ড অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধনের একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। আরএসএফ নেতা মোহামাদ হামদান হেমেদতি দাগালো যদিও এসব অভিযোগ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইয়েল হিউম্যানিটেরিয়ান রিসার্চ ল্যাব (এইচআরএল) ২৮ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে জানায়, তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে, আরএসএফ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা মানুষকে গণহারে হত্যা করছে। এই গণহত্যার মাত্রা কেবল স্যাটেলাইট চিত্রে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং আরএসএফের হাতে নিহত মোট মানুষের সংখ্যা গণনায় কমে যেতে পারে বলে প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সুদান প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট এল-ফাশেরের চিত্রকে ‘গণহত্যার ক্ষেত্র’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় সেখানে ছিলাম এবং এখানে সেই ঘটনার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমরা যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ দেখছি এবং নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে অপরাধীদের মধ্যে যে এক ধরনের গর্ববোধ দেখা যাচ্ছে, তা আমাকে ভীত করে।’

কূটনৈতিক ব্যর্থতা

এল-ফাশেরে সংঘটিত নৃশংসতার খবর ও ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিন্দা জানিয়ে আরএসএফকে ‘বেসামরিকদের সুরক্ষা’ এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানায়। তবে বেঁচে যাওয়া মানুষ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ছিল কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে শুরুতেই এমন নৃশংসতা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা।

সুদান বিশেষজ্ঞ এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হামিদ খালাফাল্লাহ বলেন, ‘আরএসএফ এত মাস ধরে এল-ফাশের দখল করার চেষ্টা করেছে; আর প্রথম দিন থেকেই আমরা জানতাম, তারা সফল হলে এল-ফাশেরের কী হবে।’ তিনি এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই ‘অস্বীকার ও বিশ্বাসঘাতকতাকে’ দায়ী করেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ গবেষক জ্যাঁ-ব্যাপটিস্ট গ্যালোপিন উল্লেখ করেন যে, আরএসএফের নতুন এলাকা দখল করার পর গণনৃশংসতা চালানোর একটি পুরোনো অভ্যাস রয়েছে, যেমনটি তারা পশ্চিম দারফুরের এল-জেনেইনা এবং আরাধামাতাতেও করেছিল। গ্যালোপিন জোর দিয়ে বলেন, কূটনীতিকরা আরএসএফ নেতা হেমেদতির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অস্বীকার করে দায়মুক্তির এই ধারা ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছেন। সম্ভবত তারা ভেবেছিলেন, এতে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যাহত হবে।

এই চলমান দায়মুক্তির কারণে আরএসএফ এল-ফাশেরে নিজেদের অপরাধের ভিডিও করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। গ্যালোপিন মনে করেন, কূটনীতিকরা একটি অধরা যুদ্ধবিরতি অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন এবং ‘সাধারণ মানুষের সুরক্ষা বা অপরাধীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা’-এমন মৌলিক বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। ফলে কেউই বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলার জন্য জবাবদিহি করছে না এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকারান্তরে এসব নৃশংসতা থেকে হাত ধুয়ে ফেলছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫