ভেনেজুয়েলার পতাকা
বিশ্বের বৃহত্তম যুদ্ধজাহাজ ক্যারিবীয় সাগরের দিকে পাঠানোর পর ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘বানোয়াট যুদ্ধ পরিস্থিতি’ তৈরির অভিযোগ করেছেন। এই ঘটনা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির একটি বড় পদক্ষেপ। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ৩১ অক্টোবর ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড বিমানবাহী রণতরিটিকে (যা ৯০টি পর্যন্ত বিমান বহন করতে সক্ষম) ভূমধ্যসাগর থেকে সরিয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।
মাদুরো দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন চিরস্থায়ী যুদ্ধ তৈরি করছে এবং তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা আর কখনো কোনো যুদ্ধে জড়াবে না, আর এখন তারা একটি যুদ্ধ তৈরি করছে।’ যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং এফ-৩৫ বিমানসহ সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তাদের দাবি, এই অভিযান মাদক পাচারকারীদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে। মার্কিন বাহিনী মাদক পাচারকারী সন্দেহে নৌকা লক্ষ্য করে এখন পর্যন্ত ১০টি বিমান হামলা চালিয়েছে।
হেগসেথ নিশ্চিত করেছেন, ৩১ অক্টোবর এক হামলায় ক্যারিবীয় সাগরে ‘ট্রেন দে আরাগুয়ার’ অপরাধী সংগঠনের একটি জাহাজে ‘ছয়জন পুরুষ মাদক-সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছে। তবে এই হামলাগুলো এই অঞ্চলে সমালোচিত হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা এর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন মাদক পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বললেও, বিশেষজ্ঞ ও কংগ্রেসের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন এটি মাদুরো সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি ভীতি প্রদর্শনের অভিযান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই মাদুরোকে একটি মাদক পাচারকারী সংগঠনের নেতা বলে অভিযুক্ত করেছেন, যদিও মাদুরো তা অস্বীকার করেন।
চ্যাথাম হাউসের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক একজন সিনিয়র ফেলো ড. ক্রিস্টোফার সাবাতিনি বলেছেন, ‘এটা হলো সরকার পরিবর্তন। তারা সম্ভবত আক্রমণ করবে না, আশা করা হচ্ছে যে এটি একটি সংকেত মাত্র।’ তিনি মনে করেন, সামরিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য হলো ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী এবং মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মহলের মনে ‘ভীতি সৃষ্টি করা’, যাতে তারা মাদুরোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
পেন্টাগনের ঘোষণা অনুযায়ী, ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড ক্যারিয়ারটিকে মার্কিন সাউদার্ন কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় মোতায়েন করা হবে, যার অন্তর্ভুক্ত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চল। মুখপাত্র শন পার্নেল জানিয়েছেন, এই অতিরিক্ত বাহিনী ‘মাদক পাচারকে ব্যাহত করতে এবং টিসিও (ট্রান্সন্যাশনাল ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) বা আন্তর্জাতিক অপরাধী সংগঠনকে দুর্বল ও ধ্বংস করার বিদ্যমান সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।’
এই রণতরি মোতায়েন স্থলভাগে হামলার জন্য প্রয়োজনীয় রসদও সরবরাহ করবে। ট্রাম্প বারবার ভেনেজুয়েলায় ‘স্থল অভিযানের’ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন এবং এই সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন, ‘আমরা এখন অবশ্যই স্থলভাগের দিকে নজর দিচ্ছি, কারণ সাগর খুব ভালোভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে কোকেন তৈরির স্থাপনা এবং মাদক পাচারের রুট লক্ষ্য করে হামলার বিষয়টি বিবেচনা করছেন, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেননি। যদিও পরে আবার তিনি এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে হামলা চালানোর বিষয়টি নাকচ করে দেন।
এদিকে ৩১ অক্টোবর ঘোষিত হামলাটি সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের চালানো মাদক পাচারকারী সন্দেহে দশম হামলা ছিল। বেশির ভাগ হামলা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে ক্যারিবীয় সাগরে হলেও ২১ ও ২২ অক্টোবর হামলাগুলো প্রশান্ত মহাসাগরেও হয়েছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা এসব হামলার আইনি বৈধতা এবং প্রেসিডেন্টের তা নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২৫ জন ডেমোক্র্যাট মার্কিন সিনেটর ১০ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে চিঠি লিখে অভিযোগ করেন, প্রশাসন কয়েক দিন আগে একটি জাহাজে হামলা করেছিল, জাহাজের ব্যক্তিরা মালামাল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল-এমন প্রমাণ ছাড়াই। তবে কেন্টাকির রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল যুক্তি দিয়েছেন-এমন হামলার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন।
অন্যদিকে ট্রাম্প দাবি করেছেন যে এসব হামলার নির্দেশ দেওয়ার আইনি কর্তৃত্ব তার আছে এবং তিনি ট্রেন দে আরাগুয়ার সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ‘যদি মানুষ মাদকবাহী নৌকা ধ্বংস হওয়া বন্ধ করতে চায়, তবে তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাঠানো বন্ধ করে।’ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক আইনজীবী ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সদস্য ব্রায়ান ফিনুকেন বলেন, পরিস্থিতিটি একটি সাংবিধানিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আর্টিকেল ১ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। সামরিক শক্তি ব্যবহারের ওপর প্রধান নিয়ন্ত্রণ মার্কিন কংগ্রেসের। এ ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের দ্বারা সেই নিয়ন্ত্রণ হরণ করা হয়েছে, তাই এখন কংগ্রেসের ওপরই এর বিরোধিতা করার দায়িত্ব।
