জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে কপ-৩০ এর সম্মেলনস্থলের বাইরে ব্রাজিলের আদিবাসীদের বিক্ষোভ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল কপ-৩০; কিন্তু আমাজনের প্রবেশমুখে উষ্ণ, ক্রান্তীয় তাপমাত্রার শহর বেলেমে যখন হাজার হাজার কূটনীতিক, পরিবেশকর্মী, সাংবাদিক ও লবিস্টরা সমবেত হয়েছেন, তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন-আলোচনার এই মহামঞ্চ কি কেবলই একটি ‘ভঙ্গুর’ প্রতিশ্রুতির কারখানা?
তিন বছর আগে যখন ব্রাজিলকে এই জলবায়ু আলোচনা আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন থেকেই প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। যে দেশটিতে ধরিত্রী সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক জলবায়ু যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই আমাজন-তীরবর্তী ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ সত্যিই জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে আশা করা হয়েছিল; কিন্তু উদ্বেগ বাড়ছে, জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনার এই ৩০তম সংস্করণটি পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতোই হতাশাজনক পরিণতির পুনরাবৃত্তি করতে চলেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জলবায়ু লক্ষ্য পূরণের দিকে বাস্তব অগ্রগতি অর্জনের পরিবর্তে আলোচনাটি আবারও উচ্চ বেতনের লবিস্ট ও কর্মকর্তাদের এক বিশাল উৎসবে পরিণত হবে, যেখানে আসল জলবায়ু উদ্বেগগুলো কেবলই পাশ কাটানো হবে।
গত বছর কপ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এসে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এর ফলাফলকে ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে বর্ণনা করেছিল। সমালোচকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, কপের প্রক্রিয়া এখন ভুল তথ্য ও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসা পক্ষদের দ্বারা আচ্ছন্ন। জলবায়ু আলোচনার এই চলন্ত সার্কাস এখন এত বড় হয়ে উঠেছে যে, এটি আর কার্যকর নেই এবং একটি বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এটি কোনোভাবেই সাহায্য করছে না।
জরুরি ব্যবস্থার অভাব
কপ-৩০ আয়োজনকারী কেন্দ্রে একজন অংশগ্রহণকারী মানচিত্র দেখছেন। কপ প্রক্রিয়া কেন ব্যর্থ হচ্ছে, তার একটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছে ক্যাম্পেইন গ্রুপ ‘গ্লোবাল উইটনেস’-এর জীবাশ্ম জ্বালানি তদন্তের প্রধান প্যাট্রিক গ্যালি বলেন, ‘মূল সমস্যা হলো, জরুরি ব্যবস্থার অভাব।’ তার এই মূল্যায়ন কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা নয়। গত বছর সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন এবং জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সাবেক প্রধান ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেসসহ জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞদের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ঘোষণা করেছিল, ‘কপ আর তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উপযুক্ত নয়।’
স্টকহোম রেজিলিয়েন্স সেন্টারের সহযোগী অধ্যাপক আলবার্ট নরস্ট্রম বলেন, ‘কপ প্রক্রিয়া যে উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, তা সে সামনে এনেছে-কূটনীতি ও ঐকমত্য। এটি আমাদের প্যারিস চুক্তি, মিথেন অঙ্গীকার এবং আর্থিক প্রক্রিয়া দিয়েছে; কিন্তু বিশ্ব এখন বাস্তবায়নের দশকে প্রবেশ করেছে এবং এখানেই কপ মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়ছে।’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘কার্বন নির্গমন এখনো বাড়ছে, কার্বন শোষণকারীরা দুর্বল হচ্ছে এবং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (শিল্প-পূর্ব স্তরের উপরে) সম্ভবত কয়েক বছরের মধ্যেই অতিক্রম করবে। কাঠামোটি তৈরি হয়েছিল আলোচনার জন্য, উচ্চাকাক্সক্ষী লেনদেনের জন্য নয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতিকে কর্মক্ষমতায় পরিণত করতে এটি ব্যর্থ হচ্ছে।’
বৈষম্যের শিকার দরিদ্র দেশগুলো
‘কনফারেন্স অব পার্টিজ’ বা কপ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের উপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা। এটি বিপজ্জনক জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির আলোচনা প্রক্রিয়া।
প্রতিবছর একটি ভিন্ন দেশে এর আয়োজন করা হয় এবং এটি সেই দেশ দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে সব সিদ্ধান্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, কোনো দৃঢ় ক্ষমতাকাঠামো যাতে গঠিত না হতে পারে এবং অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও সব দেশের একটি কণ্ঠস্বর থাকে। কিন্তু কাগজে-কলমে এমন একটি সমান্তরাল ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অসমতা মানে কিছু কণ্ঠস্বর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। কপে আলোচনার বিপুল জটিলতা এবং ইভেন্টগুলোর বিশাল আকার, যা অনেক পর্যবেক্ষকের মতে একই সঙ্গে তিনটি ইভেন্টের সমান, অর্থাৎ দরিদ্র দেশগুলো, যাদের জন্য এই সংকটটি সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাদের পক্ষে এই আলোচনার আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব। প্রক্রিয়াটি আরো বেশি জটিল হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো কপে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হয়।
জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের আগ্রাসন
জলবায়ু আলোচনায় কেবল উন্নত বিশ্বেরই যে আনুপাতিক উপস্থিতি বেশি, তা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর দ্বারা পরিচালিত লবিং অপারেশনের মাত্রাটিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের বিপুল সংখ্যা ইঙ্গিত দেয় যে, কপের একটি অংশ অপরিহার্যভাবে একটি ব্যাবসায়িক মেলায় পরিণত হয়েছে। তারা এত সংখ্যায় আসে যে, তারা শারীরিকভাবে অনেক জায়গা দখল করে। তারা হোটেল বুকিং করে এবং তারপর তারা এমন সব পার্শ্ব অনুষ্ঠানে জায়গা দখল করে, যা প্রতিনিধিদের সময় নষ্ট করে এবং তারা সেই পুরো মিথ্যা সমাধানের কাজটি করে। যাদের জীবন এই আলোচনার উপর নির্ভর করে, তাদেরই তারা কপ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখে।
নরস্ট্রম বলেন, ‘কপ-২৮-এ প্রায় আড়াই হাজার জীবাশ্ম-জ্বালানি লবিস্ট ছিল, যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রতিনিধিদলের চেয়েও বেশি। তাদের উপস্থিতি উচ্চাকাক্সক্ষা কমায়, অগ্রগতি ধীর করে এবং বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করে। যখন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো আধিপত্য বিস্তার করে, তখন আলোচনাটি জরুরি পরিবর্তন থেকে ধাপে ধাপে বিলম্বে স্থানান্তরিত হয়।’
ক্ষমতার রাজনীতিই মূল সমস্যা
গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স পার্টনারশিপের অন্যতম পরিচালক সিবেলে কোয়েরোজ বলেন, ‘কপ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রায় চুক্তি, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল প্রতিষ্ঠা এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের জন্য বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার। জলবায়ু প্রশ্নগুলোতে মনোযোগ আনা এবং জলবায়ু পদক্ষেপে উচ্চাকাক্সক্ষা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি সৃষ্টিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াটি খুব ধীর এবং অকার্যকর হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দায় ও বোঝা কে বহন করবে, তার উপর বিদ্যমান চরম বৈষম্য যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হচ্ছে না।’
রেহমানের কাছে, কপের সমস্যাগুলো বিশ্বের বিচারব্যবস্থার বৃহত্তর সমস্যাকেই প্রতিফলিত করে। তিনি বলেন, ‘কপের কাঠামোটি সমস্যা নয়; ক্ষমতাই হলো সমস্যা। এটি জটিল, কারণ... এখানে যা চলছে তা কেবল জলবায়ু নয়, এটি হলো বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি; আর তাই এটি একটি বিশাল চিত্র। এটি সত্যিই জটিল, কারণ বিশ্বের প্রতিটি একক ক্ষমতা গতিশীলতা এখানে বিদ্যমান।’
যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো কিছু চায়, যেমন তাদের অর্থনীতি এবং অবকাঠামোকে মানিয়ে নিতে সহায়তার জন্য অনুদান এবং ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা দিতে চায় না; তখন বিজয়ী কে হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। রেহমান বলেন, ‘যখন কোনো দেশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদিত হয়, তখন আপনি কি মনে করেন তা যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়? না, এটি বলিভিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনুমোদিত হয়।’
