
গত ৩০ মে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়, লকডাউনের মেয়াদ ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটি লকডাউন আনলক করার পর্যায়-১ বলেও বর্ণনা করা হয়।
এ পর্বে সব দোকান খুলে দেয়া হয়েছে। রেল, সড়ক ও বিমান পরিষেবাও শুরু হয়েছে। শপিং মল, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় স্থান ৮ জুন থেকে খুলে দেয়া হবে। সব নিষেধাজ্ঞাই এভাবে ধাপে ধাপে তুলে দেয়া হবে বলেও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
পরদিন ৩১ মে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রেডিওতে প্রচারিত তার মাসিক অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’ এ বলেন, ‘এখন সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সাথে লড়াইয়ের বিষয়ে আমাদের অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য প্রোটোকল একইভাবে মেনে চলতে হবে আমাদের।’
তিনি আরো দাবি করেন, ‘হ্যাঁ, আমরা বহু কম জনসংখ্যার দেশের তুলনায় আমাদের দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে অনেকাংশেই সফল হয়েছি।’
তবে সরকারি তথ্যও মোদির ওই দাবির পক্ষে সমর্থন দেয় না। সরকারি তথ্যেই এখন ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ; মৃতের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। অথচ মার্চে লকডাউন ঘোষণার সময়ে আক্রান্তের সংখ্যাটা ছিল পাঁচশর মতো। কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে পরীক্ষা কম করার অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডা. সুজাতা রাও বলেন, ‘ভারতে রোগী বেশি না দেখানোকে সফলতা বলে মনে করা হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষা একদমই অপ্রতুল। আবার রোগীরাও ভালো রকম আক্রান্ত না হলে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না।’
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা লকডাউনের পর ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, জুলাইয়ের ১৫ তারিখের মধ্যে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১০ লাখ। পরিস্থিতি খারাপ হলে এ সংখ্যা এক কোটিও ছাড়াতে পারে।
কঠোর লকডাউন থেকে অবস্থান বদলে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে আর্থিক বিপর্যয়ের ফলে ভঙ্গুর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ধসে পড়ার শঙ্কা। ১৯৮০ সালের পর প্রথমবারের মতো ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে এবার। দেশটি গত কয়েক বছর ধরেই বেকারত্ব বৃদ্ধিতে রেকর্ড গড়ছিল। এবার নতুন করে আরো ১০ কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে গত ২৩ মার্চ থেকে শুরু হয় ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ লকডাউন। হঠাৎ করেই কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। ১৩০ কোটি মানুষের দেশে এমন পরিকল্পনাবিহীন লকডাউন সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে আসে শ্রমজীবী মানুষের জন্য। তখন ছিল ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়। ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে যে সংক্রমণ ছড়াতে বেশি সময় নেবে না, সেটি আগেই ধারণা করা হচ্ছিল। এখন যখন ওই ধারণা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তখন লকডাউন উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অথচ গত দুই মাসেও ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার সুরক্ষাসামগ্রী, শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভারতের দুটি প্রধান নগরী মুম্বাই ও দিল্লি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। মুম্বাইয়ের হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ। এখন সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন আশপাশের রাজ্যগুলোকে ডাক্তার ও নার্স পাঠাতে অনুরোধ করছে। দিল্লিতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে জায়গা না হওয়ায়, সেখানকার সরকার বেসরকারি হাসপাতালের ২০ শতাংশ আসন কভিড-১৯ রোগীদের জন্য বরাদ্দ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. জয়প্রকাশ মুলাইল বলেন, ‘এটি এক ভয়াবহ অবস্থা। মুম্বাইয়ের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।’
মুম্বাইয়ের সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতাল পি ডি হিন্দুজা হাসপাতালের শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ ডা. ল্যান্সলট পিন্টু জানান, ওই হাসপাতালে গত তিন সপ্তাহ ধরে কভিড-১৯ ওয়ার্ডে কোনো আসন খালি নেই। রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস ভারতের স্বাস্থ্য খাতের রুগ্ণ অবস্থা আবারো সামনে নিতে এসেছে। গুজরাট হাইকোর্ট এক আদেশে আহমেদাবাদ শহরকে ‘অন্ধকূপ’ বলে উল্লেখ করেছেন। সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থা নিয়ে সেখানকার মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার পরও কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য জানানোই বন্ধ করে দিয়েছে। হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠনেরও আদেশ দিয়েছেন।
স্বাভাবিক অবস্থায়ই যেখানে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকে না; সেখানে মহামারির সময়ে যে সোনার হরিণ হয়ে উঠবে, এটি খুব স্বাভাবিক। দীর্ঘ লকডাউনে অনেক হাসপাতাল তাদের কাজের পরিধি কমিয়ে এনেছে। বিভিন্ন শহরের অনেক হাসপাতাল আবার পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
রুগ্ণ স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনারই শিকার হন আগ্রা নিবাসী আর ভি সিং পুন্ধির। ৬৪ বছর বয়সী এই কিডনি রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো। তিনি যে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেন, সেটি এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায়। তার মেয়ে আকাক্ষা পুন্ধির জানান, কিছুদিন পর একদিন সকালে তার বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সাথে সাথেই তাকে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়; কিন্তু সেখানে ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ঘোরার পর এক হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার আগে তারা ডায়ালাইসিস করতে পারবেন না। এরপর শুরু হয় পরীক্ষা করানোর চেষ্টা; কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে পরীক্ষায় জানা যায়, আর ভি সিং পুন্ধির ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না।
আকাক্ষা বলেন, ‘এমনটা যে হতে পারে, তা আমরা জীবনেও ভাবিনি। আমরা ভাবছিলাম কোনো না কোনো হাসপাতাল তো চিকিৎসা দেবে। এ মৃত্যু অবধারিত ছিল না।’
ভারতের সব রাজ্যের অবস্থা অবশ্য একইরকম নয়। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণের রাজ্য কেরালা ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সেখানকার শক্তিশালী স্বাস্থ্য খাতকে রাজ্য সরকার পুরোদমে ব্যবহার করেছে আক্রান্তদের খুঁজে বের করা, চিকিৎসা দেয়া ও আইসোলেশনের ক্ষেত্রে। সেই সাথে মানবিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে সেখানে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে।
তবে সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশ থেকে শ্রমিকরা ফিরে আসায় কেরালায়ও আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, লকডাউন শুরুর পর থেকে বহু শ্রমিককে হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদে রেললাইন ধরে হেঁটে ফেরার সময় রাতে রেললাইনের ওপরেই ঘুমিয়েছিলেন শ্রমিকরা। ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১৬ শ্রমিকের। এছাড়া হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আবার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকে বহু মানুষ বাড়ি ফিরছেন। সেখানেও ৩১ তারিখ পর্যন্ত অব্যবস্থায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৮০ জনের। সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে ওই শ্রমিকদের, যারা অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে বাড়ি পৌঁছেছেন; তাদের আবার ফিরতে হবে নগরীতে। তাদের জন্য কোনো বাড়তি বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশই যেন একমাত্র অবলম্বন!
‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মোদি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর চিত্র তুলে ধরে সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে বলছেন; কিন্তু বড় শিল্পপতিদের প্রতি এমন কোনো নির্দেশনা দেননি।
উল্লেখ্য অতি ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপের যে সুপারিশ দেশটির জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তরুণ কর্মকর্তারা করেছিলেন, এতে আমল না দিয়ে উল্টো ওই কর্মকর্তাদেরই বরখাস্ত করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।