Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

চীনা পণ্য বর্জন, মানছে না ভারতের জনগণ

Icon

লোকমান তাজ

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২০, ১০:০০

চীনা পণ্য বর্জন, মানছে না ভারতের জনগণ

লাদাখে সংঘর্ষের ফলে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠে ভারত-চীন সম্পর্ক। লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় চীন-ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এক কর্নেলসহ ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এতে চীনা পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেয় ভারতের ব্যবসায়ী সংগঠন কনফেডারেশন অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (সিএআইটি)।

সর্ব ভারতীয় এ ব্যবসায়ী সংগঠনটির পক্ষ থেকে অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয় কুমার, মাহেন্দ্র সিং ধোনি ও শচিন টেন্ডুলকারকে ভারতীয়া সামান হামার অভিমান ক্যাম্পেইনের অধীনে চীনা পণ্য প্রচার বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। সাত কোটি ব্যবসায়ী ও ৪০ হাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিত্বের দাবি করে সংগঠনটি বলে, বিভিন্ন আইটেমের তালিকা তৈরি করা হয়েছে যা বর্জন করা যেতে পারে। প্রচারণার অংশ হিসেবে ব্যবসায়ীদের চীনা পণ্য বিক্রি না করতে উদ্বুদ্ধ এবং ক্রেতাদের দেশীয় পণ্য কিনতে আহ্বান জানানো হয়।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনা পণ্য ব্যবহারে সরকারের দিক থেকে নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ অধিদফতর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডকে ৪ জি-তে উন্নীত করার ক্ষেত্রে চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার না করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

এর ফলে চীনা পণ্যবিরোধী বিক্ষোভ দেখা যায় ভারতের রাজপথে। লাদাখে চীন-ভারত সংঘাতের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এমন বিক্ষোভ হয়।  শুধু যে খেলনা বা মোবাইল নয়, গাড়ি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লার বা পরমাণু বিদ্যুতের রিঅ্যাক্টর - সব ক্ষেত্রেই চীনের পণ্য। তবুও ভারতে চীনা পণ্য বয়কট করার দাবি জোরালো উঠে।  

তবে চীনা পণ্য বর্জনের ঘোষণায় বেশ বড় বিপদে পড়তে হয় দেশটিকে। শুধু টিভি ফ্রিজ নয়, ওষুধের কাঁচামালের দাম বাড়ায় ভারতীয়দের গুণতে হয় বাড়তি অর্থ। কেননা তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ৮০ শতাংশই ভারত আমদানি করে চীন থেকে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, উত্তরাখণ্ডে শতাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয় রয়েছে। সেখানকার এক শীর্ষ ওষুধ উৎপাদক সংস্থার কর্ণধার জানিয়েছেন, গালওয়ান উপত্যকার ঘটনায় চীন বয়কটের ডাক ওঠার জেরে ওষুধের কাঁচামাল সরবরাহকারী সংস্থাগুলো রাতারাতি ৩০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দোহাই দিলেও মূলত অনৈতিক উপায়ে লাভবান হওয়ার জন্যই এগুলো করা হয় বলে মত এ ব্যবসায়ীর।

শুধু ওষুধে নয় এর প্রভাব রয়েছে ভারতের ক্রীড়াঙ্গনেও। আর সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভারতীয় খেলাধুলার বাজারে চীনা পণ্য বয়কট করা এত সহজ নয়। টেবিল টেনিস বল, শাটলকক, ব্যাডমিন্টন ও টেনিসের র‌্যাকেট, কুস্তির মাদুর, বর্শা, হাই জাম্পের থাম, বক্সিংয়ের শিরস্ত্রাণ  (হেলমেট), পর্বত আরোহণের জিনিসপত্র ও অন্যান্য খেলাধুলার সামগ্রী চীন থেকে আমদানি করে ভারত।

ভারতীয় খেলার বাজারে চীনের আধিপত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ২০১৮-১৯ চক্রে শতকরা ৫০ শতাংশের বেশি ক্রীড়াসামগ্রী চীন থেকে আমদানি করেছে ভারত। দেশটির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ভিএটিএস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকেশ ভাট বলেন, খেলার বাজারে তাদের শেয়ার ৫০ শতাংশের বেশি।

আমরা বলি স্থানীয়দের সঙ্গে থাকুন। কিন্তু সরকারের নীতি চীনের পণ্যকে বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ করে দিয়েছে।


আইটিএফ র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারতের সেরা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় সাথিয়ান গনসেকরান জানান, র‌্যাকেট ও টেবিলে ভারত স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু বলের বাজারে তা নয়। সেখানে চীনের তৈরি বলের একাধিপত্য। গনসেকরান বলেন, স্পিন ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সব ভারতীয় খেলোয়াড় চীনের তৈরি বল দিয়ে অনুশীলন করে। অন্যান্য পর্যায়ে আলাদা ব্র্যান্ডের আলাদা বল দেখবেন। এমনকি স্টিগা (সুইডেন) কিংবা ভারতের স্ট্যাগ কিনলেও দেখবেন এ বলগুলো সব চীনে তৈরি।

ভারতের বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জয় কোওলি গণমাধ্যমকে জানান, অস্ট্রেলিয়ার স্টিং প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া পণ্য ভারতীয় বক্সারদের মাঝে জনপ্রিয়। তবে এগুলো সব চীনে তৈরি হয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ টুর্নামেন্টে অবশ্য দেশি বক্সিং ক্রীড়াসরঞ্জামের কদর আছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টের চাহিদা মেটায় বক্সিংয়ের ভারতে তৈরি  ক্রীড়াসরঞ্জাম। কিন্তু উঁচু মানের টুর্নামেন্ট ও ভালো বক্সারের জন্য বাইরে থেকে সরঞ্জাম আমদানি করতে হয়। ২০১৮-১৯ চক্রে বক্সিংয়ে ভারতের খরচ করা ৩ কোটি রুপির মধ্যে ১.৩৮ কোটি পেয়েছে চীন।

হকি স্টিক, বল, ক্রিকেট ব্যাট ও বল এসব মূলত রপ্তানি করে থাকে ভারত। সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, এসব সরঞ্জাম তৈরির কাঁচামালের জন্য ভারত চীনের ওপর নির্ভরশীল। ভারতের ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল ব্র্যান্ড ভেক্টর-এর মুখপাত্র বিকাশ গুপ্ত জানান, বল তৈরিতে পলিইউরেথ্রিন এবং ইথিলিন-ভিনাইল তারা চীন থেকে আমদানি করেন। বিকাশ বলেন, ভারতের কাঁচামাল তৈরির প্রক্রিয়া ভালো না। ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে কাঁচামালে যে মানের প্রয়োজন তা হয় না।

শরীরচর্চায় জিমনেশিয়ামের নানা জিনিসপত্রেও রয়েছে চীনা পণ্যের আধিপত্য। লোকেশ ভাট বলেন, ‘জিমে লোহার রড, বেঞ্চ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র চীন থেকে আমদানি করা হয়। ট্র্যাকস্যুটের সুতোও চীনের। কারণ, ওদেরগুলো সস্তা। লোকেশ বলেন, বাজার গবেষণা, উন্নয়ন এবং দামের সমস্যাগুলো আগে ঠিক করতে হবে। হুট করেই আমরা চাইনিজ পণ্য বয়কট শুরু করতে পারি না।

আর এর ফল বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ক্রেতারা বিশেষ করে চীনা মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্য কেনায় বিন্দুমাত্র রাশ টানছেন না এখন। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে চীনা মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যে সব প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে, তা উড়ে গেছে নিমেষের মধ্যে। সাধারণ গ্রাহকরা বলছেন, চীনা কোম্পানিগুলি শস্তায় ভাল মানের পণ্য দিতে পারে বলেই সেগুলোর এত কদর।

ভারতীয়দের যে চীনা মোবাইল ফোন ও সব ধরনের চীনা অ্যাপ অবিলম্বে বয়কট করা উচিত, মাসখানেক আগে প্রথম সে ডাক দিয়েছিলেন লাদাখের জনপ্রিয় শিক্ষা সংস্কারক সোনাম ওয়াংচুক, যার আদলে তৈরি হয়েছিল বলিউডের থ্রি ইডিয়টস ছবির বিখ্যাত র‍্যাঞ্চো চরিত্রটি। মি ওয়াংচুকের যুক্তি ছিলো, চীনা পণ্য বর্জন করলে শুধু চীনের আগ্রাসী নীতিরই প্রতিবাদ জানানো হবে তাই নয় – ভারতের দেশজ শিল্পও স্বনির্ভর হবে, উপকৃত হবে।

গালওয়ান উপত্যকায় দিনদশেক আগে কুড়িজন ভারতীয় সেনা চীনা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর সে দাবি আরো জোরালো হয়েছে ঠিকই – কিন্তু অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টের সেলে চীনা ফোনের দেদার বিক্রি কিন্তু অন্য কথাই বলে। বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন যে ই-কমার্স সাইটের সেলের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, সেখানে এখন হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে রেডমি, অপ্পো, ভিভো, ওয়ানপ্লাসের মতো চীনা কোম্পানির ফোন।

গত সপ্তাহেই অ্যামাজনে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে উড়ে গেছে ওয়ানপ্লাসের লেটেস্ট মডেল। দিল্লির তরুণ বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত মনে করেন, চীনা স্মার্টফোনের যে বিকল্পগুলো রয়েছে সেগুলোর দাম তুলনায় বড্ড বেশি বলেই ক্রেতারা চীনা ফোনের দিকে ঝুঁকছেন। তার কথায়, দেখুন, আমার ফোন কেনার বাজেট যদি হয় দশ হাজার টাকা তাহলে সেই পয়সায় রেডমি, রিয়েলমি বা এমন কী পোকো যে স্পেসিফিকেশনস দিচ্ছে, কোরিয়ার স্যামসুং চল্লিশ হাজার টাকার নিচে তা দিতে পারছে না। অ্যাপল তো আরো বেশি।

বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত বলেন, একইভাবে আমার কাছে যদি ৫০ হাজার টাকা থাকে, তাহলে চীনের ওয়ান প্লাস এইট কিংবা ওয়ান প্লাস এইট প্রো আমায় যত সুবিধা দিচ্ছে ওই পয়সায় আইফোনও তা দিতে পারছে না। আর স্যামসুং দিতে গেলে দাম পৌঁছে যাচ্ছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়! কাজেই ভারতীয়দের হয়তো এখন চীনা ফোন বর্জন করা উচিত ঠিকই, কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যাচ্ছে ভ্যালু ফর মানির দিকে দিয়ে চীনের প্রোডাক্ট আসলে অনেক এগিয়ে।


ভারতের নামী থিঙ্কট্যাঙ্ক ইকরিয়েরের অর্থনীতিবিদ অর্পিতা মুখার্জি আবার এ প্রসঙ্গে দিকনির্দেশ করছেন ক্রেতাদের একটা বিশেষ স্বভাবের দিকে।

ড. অর্পিতা মুখার্জি বলেন, কনজিউমার বা ক্রেতা কিছু কিনতে গেলে প্রথমে সে জিনিসটার মান দেখে, আর দামের তুলনা করে অন্যান্য একই ধরনের পণ্যের সঙ্গে। ধরুন, জিনিসটা মোবাইল ফোন হলে সে তার স্পেকস, স্টোরেজ, ক্যামেরা এই সব আগে দেখবে। কিংবা দেখবে ইউজেবিলিটি, ফোনের ওজন। কান্ট্রি অব অরিজিন অব দ্য ফিনিশড প্রোডাক্ট সবার শেষে দেখাটাই দস্তুর। আর তা ছাড়া মোবাইল ফোনের সাপ্লাই চেইন-ও খুব ফ্র্যাগমেন্টেড, মানে নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। যেমন অ্যাপলের আইফোনই তৈরি হয় প্রায় নব্বইটার মতো দেশে। ফলে একটা ফোনের যন্ত্রাংশ কোন দেশ থেকে কতটা আসছে, কোথায় অ্যাসেম্বলড হচ্ছে – ক্রেতা তা অনেক সময় জানেই না, কিংবা জানতেও চায় না।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আমলে যে ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের ঐতিহ্য আছে, তারা এখন চীনের পণ্য বর্জনের ব্যাপারে কেন এত নিরুৎসাহী?

ড. মুখার্জির মতে, তারা আসলে এখন বেশ বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যহীন। বদেশি আন্দোলনটা ছিল সার্বিক স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ, সেখানে উদ্দেশ্যটাও ছিল একেবারে পরিষ্কার – ইংরেজকে দেশছাড়া করা। কিন্তু এখানে যুদ্ধটা আপনি কার সঙ্গে লড়ছেন সেটাই তো পরিষ্কার নয়। আপনি কি সেই ভারতীয় ম্যানুফ্যাকচারারের বিরুদ্ধে লড়ছেন যার ফ্যাক্টরি চীনে, কিংবা যে চীন থেকে কিছু যন্ত্রাংশ আমদানি করে? না কি আপনি সেই ভারতীয় বিক্রেতার বিরুদ্ধেই লড়ছেন যে চীন থেকে জিনিস এনে এ দেশের নানা প্ল্যাটফের্মে বিক্রি করছে? স্বদেশি আন্দোলনের মতো এখানে কোনও স্পষ্ট দিশা নেই বলেই আসলে মুশকিল।

ফলে ভারতে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক সফল হতে গেলে তাতে আরো অনেক সময় লাগবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর সেই ফাঁকে দেশি কোম্পানিগুলোকেও চীনের সঙ্গে টক্কর দেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জেও উতরোতে হবে, নইলে ভারতীয় ক্রেতা হয়তো বেশি দাম দিয়ে কখনোই কম মানের জিনিস কিনতে চাইবেন না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫