Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

জন্মের পর থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে ভারত

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২০, ১৩:৪৫

জন্মের পর থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে ভারত

১৬ থেকে ১৮ জুনের মাঝে তিন দফা আলোচনার পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, আটককৃত দুইজন অফিসারসহ ১০ জন ভারতীয় সেনাকে ফেরত দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। 

১৫ জুন ভারতীয় কর্মকর্তারা জানায়, চীনাদের সাথে লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় উভয় পক্ষের প্রায় ৫০০ সেনার ব্যাপক সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন, যাদের মাঝে একজন কর্নেলও রয়েছেন। দুই দেশের মাঝে চার দশকে এটি সবচেয়ে মারাত্মক সীমান্ত সংঘর্ষ। 

১৮ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলে আসছিল, চীনাদের হাতে কোনো ভারতীয় সেনা আটক নেই। উত্তেজনা প্রশমণে উভয় পক্ষ মে মাসের শুরু থেকে সাতবার আলোচনায় বসেছে। 

২০ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অফিস থেকে এক বার্তায় বলা হয়, ভারতীয় সেনাদের বীরত্বের কারণেই চীনারা ভারতের সীমানার অভ্যন্তরে ঢুকতে পারেনি, আর মোদি সরকার চীনাদের ইচ্ছেমতো দুই দেশের বিরোধপূর্ণ সীমানা পরিবর্তন করতে দেবে না। যদিও এর আগে ১৭ জুন মোদি ঘোষণা দেন যে, তার সরকার চীনাদের উচিত জবাব দেবে। তবে গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনাদের বীরের মতো সীমানা রক্ষা করার বার্তা দিয়ে মোদি তার কঠোর হুমকি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছেন। আঞ্চলিক বাস্তবতা যে ভারতের যথেষ্টই বিপক্ষে যাচ্ছে, তা প্রতিবেশী নেপাল ও বাংলাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। 

গত ৯ জুন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নেপাল ও চীনের সীমান্তে লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত একটা রাস্তা উদ্বোধন করেন। নেপাল এই অঞ্চলকে তার নিজের সীমানার অভ্যন্তরে বলে মনে করে। ১৯৫০ এর দশক থেকেই নেপাল চাইছে উভয় দেশ আলোচনায় বসে যাতে বাউন্ডারির সমস্যাগুলো সুরাহা করে; কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেপালকে আলোচনায় বসার সময় দেয়নি। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনারা ওই অঞ্চল দখল করে নেয়। 

গত ১১ মে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গিয়াওয়ালি নিজে কাঠমান্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূত ভিনায় মোহন কোয়াত্রাকে ডেকে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করেন। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কেবল তারা নেপালের সাথে আলোচনায় বসবে। অপরদিকে নেপাল বলছে, করোনাভাইরাসের সমস্যা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে পারবে না। 

১৩ জুন নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে দেশটির নতুন মানচিত্রকে সংবিধানের অংশ করে প্রস্তাব পাস হয়। এই মানচিত্রে কালাপানি, লিপুলেখ গিরিপথ ও লিম্পিয়াধুরা এলাকাকে নেপালের অংশ দেখানো হয়। 

১৯ জুন নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে এই প্রস্তাব পাস হলে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র বিষ্ণু রিজাল ঘোষণা দেন, নেপাল কালাপানিতে একটি সেনা ক্যাম্প তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। ১৭ মে নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল পূর্ণ চন্দ্র থাপা কালাপানি সীমান্ত এলাকা সফর করেন। নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যস্ত চীন। 

১৬ জুন বেইজিং সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য বা পাঁচ হাজার ১৬১টি পণ্যকে চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেবে। ব্যাপারটা ভারতীয়দের বিচলিত করেছে। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিক যে সময়ে লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে, তখনই চীন হয়তো বাংলাদেশকে তার পক্ষে টানতে চাইছে। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে গড়ে তোলা সুসম্পর্ক এখন হুমকির মুখে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়। 

এই সম্পর্ক গত বছরই চাপের মাঝে পড়েছে, যখন ভারতে এনআরসি ও এর পরবর্তীতে সিএএ আইন নিয়ে ঢাকায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও গত ১৯ মে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঢাকা নর্থ সিটি করপোরেশনকে ‘সিস্টার সিটি’ নামের এক কনসেপ্টে যুক্ত হওয়ার জন্যে আহ্বান জানানো হয়। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের সমস্যা দূরীকরণে চীনা শহরের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে দুই দেশের জনগণের মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন হবে বলে আশা করা হয়। 

এই ব্যাপারটিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সহজভাবে নিতে পারেনি। ভারতের শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক লেখায় এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আবার বাংলাদেশের সাথে চীনের বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কেন দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েন সৃষ্টি করছে না, সে ব্যাপারেও হতাশা প্রকাশ করা হয়।  

গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাদের প্রাণহানির পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক টুইটার বার্তায় মার্কিন সরকারের সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। আলজাজিরা জানায়, গত দুই দশকে ভারত ওয়াশিংটনের সাথে নিবিড় রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীদের অন্যতম। 

ভারতীয় চিন্তাবিদদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করার পরামর্শ দিচ্ছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও দ্য হিন্দু পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, এখন ভারতের উচিত কৌশলগত সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারস্পরিক স্বার্থের জোরালো সমন্বয় করা। একইসাথে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আসিয়ানের সাথেও সম্পর্ক গভীর করা। তবে ভারতের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে তিনি কোনো কথাই বলেননি। 

অর্থনৈতিক দৈন্যতা, সামাজিক অস্থিরতা, জাতিগত ও ধর্মীয় অসন্তোষের মাঝে করোনাভাইরাস দুর্যোগে ভারত যখন নাকাল, তখনই শুরু হলো এই সীমান্ত সংঘাত। ভারতের জন্য ভৌগোলিক সীমানাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকেই নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতা ভারতকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাচ্ছে। এ কারণেই স্থলসীমানাবেষ্টিত ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের স্থিতাবস্থা ভারতের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ। 

লাদাখের সীমান্ত বিরোধ ভারতকে এমন এক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে ফেলেছে, যেখানে বহুদূরের মার্কিন সহায়তা পেলেও নিজস্ব স্থলসীমানায় অবস্থিত চারটি দেশ- চীন, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চিত নয় ভারত, যা দেশটির জন্মের পর থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫