বৈরুত বিস্ফোরণের পর লেবাননে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২০, ১০:১৬

ফাইল ছবি
গত ৯ আগস্ট ফরাসি নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী ও জরুরি সহায়তা নিয়ে ফ্রান্স থেকে লেবাননের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের গুদামে বিস্ফোরণের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত নগরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তা আসছে। ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ প্রেরণও এই সহায়তার অংশ।
ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওই জাহাজে খাদ্যসামগ্রী ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম ছাড়াও রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ, বৈরুত বন্দরের সার্ভে কাজের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক সরঞ্জাম, নৌবাহিনীর ডুবুরি দল, ল্যান্ডিং ক্রাফট, হেলিকপ্টার, অগ্নি নির্বাপক দল, কন্সট্রাকশন সরঞ্জামসহ সাড়ে তিনশ’ জনের বহর। লেবাননের পথে মানবিক সহায়তা নিয়ে রওয়ানা হলেও ২১ হাজার টনের বিশাল এই যুদ্ধজাহাজের সক্ষমতা রয়েছে সাড়ে ৪০০ থেকে ৯০০ সৈন্য, ৪০টি ভারী ট্যাঙ্ক, চারটি ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং ২০ থেকে ৩৫টি হেলিকপ্টার বহন করার।
১২ আগস্ট ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এক টুইটার বার্তায় ঘোষণা দেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসকে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। এর মাঝে হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনিয়েরে’ও রয়েছে। এই ঘোষণার সাথে সাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। মোট কথা ফ্রান্স পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে লেবাননের ইস্যুটিকেই ব্যবহার করেছে, যা লেবাননে ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশের সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যকেও আলোচনায় নিয়ে আসে।
গত ৪ আগস্ট বৈরুতের বন্দর এলাকায় মারাত্মক বিস্ফোরণে দেশটির প্রধান খাদ্য গুদাম ধ্বংস হওয়ার পর রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে লেবাননের অর্থমন্ত্রী রাউল নেহমের বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশটিতে এক মাসেরও কম সময়ের খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। তবে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই গুদাম ধ্বংস হওয়াই প্রধান সমস্যা নয়। কভিড-১৯ দুর্যোগের আগেই লেবাননের অর্থনীতি পুরোপুরি ধসে পড়েছিল। মূলত এ কারণেই লেবানন সরকারের পক্ষে খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়ে। লেবাননের আমদানিকারক সিন্ডিকেটের প্রধান হানি বোহসালি জানান, অন্যান্য দেশ সহায়তা না করলে দেশটি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এই দুর্যোগকে আশপাশের শক্তিশালী দেশগুলো লেবানন তথা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বৃদ্ধি করার সুযোগ হিসেবেই দেখেছে।
৬ আগস্ট ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ছুটে যান বৈরুতে। ডয়চে ভেলে জানায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফরাসিরা লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৩ সালে লেবাননকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার পরও ফ্রান্স তার সেই প্রভাব ধরে রেখেছে। লেবাননের মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সকে তাদের রক্ষাকারী হিসেবেই দেখে। লেবাননের ক্ষমতাবান লোকেরা ফ্রান্সে বাড়ি বানিয়েছে, ফরাসি ভাষা শিখেছে, নিজেদের স্কুলে ফরাসি ভাষাকে মূল ভাষা হিসেবে শিক্ষা দিয়েছে। তাই বৈরুতে ম্যাখোঁর সফরকে অনেকেই লেবাননে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক এলি আবুআউনের মতে, ফ্রান্স একা নয়, লেবাননে ইরান ও সৌদি আরবেরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। লেবাননের বিশ্বাসগত বিভাজনের ওপরই দেশটির রাজনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। খ্রিস্টানদের সমর্থনদাতা হলো ফ্রান্স; শিয়াদের পিছনে রয়েছে ইরান; সুন্নিদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র এখানে ধীরে ধীরে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। অপরদিকে রাশিয়া ও তুরস্কও চেষ্টা শুরু করেছে।
লেবাননে দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধের পর ১৯৮৯ সালে তায়েফ সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করা হয়, লেবাননের পার্লামেন্টে ১২৮টি আসনের মধ্যে ৪৩টি পাবে মারোনাইট খ্রিস্টানরা, ২৭টি পাবে সুন্নি মুসলিমরা, ২৭টি পাবে শিয়ারা, ২০টি পাবে ইস্টার্ন অর্থোডকস খিস্টানরা, আটটি পাবে দ্রুজরা, দুটি পাবে আলাওয়াতিরা ও একটি পাবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরা।
১৯৪৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী, দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন একজন মারোনাইট খ্রিস্টান ও প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন সুন্নি মুসলিম। এই ব্যবস্থায় মারোনাইট খ্রিস্টানরা ফ্রান্সের অধীনে যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, তার পরিবর্তন করে মুসলিমদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তবে রাজনৈতিক বিভেদের এই ব্যবস্থায় লেবাননে কোনোদিনই শক্তিশালী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। বিদেশি শক্তিই বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ নিয়ে লেবাননের রাজনীতিতে কলকাঠি নেড়েছে।
গত মার্চে লেবানন সরকার ঘোষণা দেয়, দেশটি প্রথমবারের মতো ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে পারছে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানান, এই ঋণের ওপর সুদ পরিশোধ করা লেবাননের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, লেবাননের ব্যাংকগুলো দেশটির নিজস্ব মুদ্রা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরে বাধা দেয়ার ফলে দেশটির মুদ্রার মান মারাত্মক কমে যায়; যার ফলশ্রুতিতে লেবানিজ পাউন্ড প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়ে। একইসাথে দেশটিতে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। ঋণদাতাদের নেতৃত্ব দেয়া ফ্রান্স চাইছে দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কার হোক। রয়টার্স জানায়, ম্যাখোঁ চাইছেন, লেবাননের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে রাজি করাতে। এর মাধ্যমে অতি ঋণগ্রস্ত এই দেশটিকে একটি টেকনোক্র্যাট সরকারের অধীনে নিয়ে আসলে দাতা দেশগুলো লেবাননের জন্য আবারো কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণের ব্যবস্থা করবে।
লেবাননের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হওয়ায় দেশটির আকারের তুলনায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ফ্রান্স তার হারানো প্রভাব ফিরে পেতে যেমন লেবাননে তার অবস্থানকে শক্ত করতে চাইছে, তেমনি ইরান ও সৌদি আরবও চাইছে তাদের অবস্থান যাতে কিছুতেই দুর্বল না হয়। সৌদি আরব, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরো অনেক দেশ লেবাননে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো অব্যাহত রেখেছে।
ব্রিটেন নৌবাহিনীর সার্ভে জাহাজ পাঠিয়েছে বৈরুত বন্দরকে চালু করায় সহায়তা দিতে। তুরস্ক আবার চাইছে বৈরুতের সমুদ্র বন্দরের উন্নয়ন করতে। অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় সর্বশেষ খেলোয়াড় তুরস্ক। তবে লেবাননের উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ছত্রছায়ায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিসের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করার ফরাসি কৌশলই বলে দিচ্ছে, ফ্রান্স তুরস্কের হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।
লেবাননের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা ও বৈরুত বিস্ফোরণ দেশের মানুষের জন্য যতটা কঠিন সময় এনে দিয়েছে, ততটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় শক্তিগুলোর মাঝে।