
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফাইল ছবি
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো- ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। তবে এর মাঝে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পেছনে পড়ে যাচ্ছে, যা হলো- ইরানের সঙ্গে চীনের কৌশলগত চুক্তি।
২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের তেহরান সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চলতি বছর জুলাই মাসে ‘ফাঁস হওয়া’ নথির ওপর ভিত্তি করে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ২৫ বছর মেয়াদি এই বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ইরানের জন্য নতুন জীবন এনে দেবে ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পাবে।
যদিও সেই চুক্তিতে সামরিক ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলা ছিল না, তবে ইরানের বিরোধী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ও তার সমর্থকরা বলতে থাকেন- চুক্তি মোতাবেক ইরান খুব সম্ভবত পারস্য উপসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ চীনকে লিজ দিতে যাচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘চীনের বিনিয়োগের কারণে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড কোরের হাতে প্রচুর অর্থ যাবে ও তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। একইসাথে তা ইসরায়েল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিরাপত্তাকে ব্যাহত করবে।’ ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের কট্টরপন্থীরাই চীনা বিনিয়োগের বিরোধিতা করছেন।
এই চুক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় পত্রিকা দ্য প্রিন্ট জানায়, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইরানে ছুটে গিয়েছিলেন এটা নিশ্চিত করতে যে, ইরানে ভারতের ছবাহার সমুদ্রবন্দর প্রকল্প যেন চীনারা ব্যবহার করতে না পারে। ভারত এই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করেছে, যার মাঝে ছিল ছবাহার বন্দরের উন্নয়ন করা। তবে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের মাঝে ছিল ছবাহার থেকে তুর্কমেনিস্তানের সীমানা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা; যা বাস্তবায়িত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের হুমকির মুখে ভারত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারছে না; তাই ইরান চাইছে প্রকল্পটা নিজেরাই এগিয়ে নিতে। ভারতের ভয় হলো- চীনারা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।
ব্যাপারটাকে আরো একধাপ এগিয়ে বৃহত্তর দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। আয়েল প্রাইস পত্রিকার এক লেখায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়- ছবাহার বন্দরে চীন ও রাশিয়ার সহায়তায় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। প্রশ্ন হলো- আসলেই কি ইরান-চীন চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে?
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ক্যারেন ইয়াং আল মনিটরের এক লেখায় বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কাছে চীন দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে উঠছে, মধ্যপ্রাচ্যে চীনের উত্থান সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিচ্ছে। এই কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের বলা হচ্ছে- হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকতে হবে, নতুবা চীনের সাথে। অথচ মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনকে পুরোপুরি বাদ দেয়াটা একেবারেই অবাস্তব।
তিনি ওই লেখায় আরো বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিনিয়োগ প্রতিটি দেশই পেতে চাইছে। এতে যুক্ত হতে অঞ্চলিক প্রতিযোগিতাও দেখা যেতে পারে; কিন্তু চীন এই প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে নেই।
ভারতীয় মিডিয়া স্ট্র্যাটেজিক নিউজ গ্লোবালকে মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসির ডিরেক্টর কামরান বোখারি বলেন, ইরানের সাথে চীনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের দরকষাকষির সুযোগ করে দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় সৌদি আরবে চীনা পারমাণবিক বিনিয়োগের ব্যাপারে রিপোর্ট করে মার্কিন জনমতকে চীনের বিপক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। একই সুরে ইরানে চীনের বিনিয়োগ বা লাদাখে ভারতের সাথে সীমান্ত দ্বন্দ্ব যে মার্কিন স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে, তা কেউ কেউ মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে কামরান বোখারি বলেন, ‘চীনের এই বিনিয়োগগুলোকে তাদের বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। চীনারা পাকিস্তানে বড় বিনিয়োগ করছে, একইসাথে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও বিনিয়োগ করছে। চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে অত্র অঞ্চল যদি স্থিতিশীল থাকে, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। অর্থাৎ, চীনা অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের অখুশি থাকার কথা নয়।’
তবে তিনি আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না, দীর্ঘ মেয়াদে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাব অনেক বেড়ে যাক।’
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়; কারণ চীনের যেমন বড় বাজার রয়েছে; তেমনি দেশটি বিভিন্ন পণ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। চীনকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছুক নয় কেউ। অপরদিকে চীনও এই অঞ্চলে ইরান ও সৌদি গ্রুপের মধ্যকার দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাতে চীনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই চীন এখানে সবাইকে ব্যালান্স করেই চলতে চাইবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতি কমে যাওয়ায় বিভিন্ন পক্ষ ইরানে চীনা বিনিয়োগকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিস্থাপন বা আঞ্চলিক হুমকি বলে দেখাতে চাইছে।
ওয়াশিংটনের কট্টরপন্থীরা যেমন চাইছে এ বিষয়টিকে আলোচনায় এনে চীনের বিরুদ্ধে শক্তি জড়ো করতে; অন্যদিকে ইরানের কট্টরপন্থীরা চাইছে এই চুক্তিকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে তেহরানের বর্তমান সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে স্বল্প মেয়াদে চিন্তিত নয়; কারণ অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে চীনা প্রভাবও তার জন্য চিন্তার কারণ।