নির্বাচনে যে ইস্যুতে ঘায়েল হতে পারেন ট্রাম্প

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২০, ১১:৩৮

ডোনাল্ড ট্রাম্প
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা- দুইদিক থেকেই বিশ্বের তালিকার এক নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত সেদেশে ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে আর মারা গেছে দুই লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি।
মহামারির ভয়াবহ এই চিত্র এখনো বিন্দুমাত্র মলিন হয়নি। বরং দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে সংক্রমণের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়ছে। প্রতিদিন এখন প্রায় ৮৯ হাজার মার্কিনি নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে।
এরমধ্যে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় এক লাখ আর মৃত্যু হয়েছে এক হাজার। নির্বাচনের তিনদিন আগে এমন চিত্র আশা করেননি দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কারণ মার্কিন বিশ্লেষকদের মধ্যে বড় কোনো দ্বিমত নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে এক নম্বর ইস্যু- করোনাভাইরাস। আর ট্রাম্প যদি এবারের নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে এর প্রধান কারণ হবে কভিড-১৯ নামের এই অদৃশ্য শত্রু।
আবার বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, এবার রেকর্ড আগাম ভোটের অন্যতম কারণও কভিড। বিধিনিষেধের কারণে মঙ্গলবার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারার উদ্বেগ যেমন এই আগাম ভোটারদের মধ্যে কাজ করেছে তেমনি অনেক পর্যবেক্ষকের মতে- কভিড মোকাবিলায় সরকারের পারফরমেন্সে নিয়ে তাদের মনোভাব ব্যালটের মাধ্যমে দেখাতে অনেকেই উন্মুখ।
রেকর্ড ৯ কোটি ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন, যা ২০১৬ সালে দেয়া মোট ভোটার উপস্থিতির ৬০ শতাংশ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গত সাতমাস ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মহামারি সামাল দিতে যা করছেন বা বলছেন, ভোটের সিদ্ধান্তে তার প্রভাব কী হচ্ছে?
কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণীর কথা ছিল, যেভাবে তিনি (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প) পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন তা খুবই দুর্বল। অন্যদিকে মাঝবয়েসী শ্বেতাঙ্গ এক নারীর কথা ছিল এরকম, প্রেসিডেন্ট চাইছেন সবাই যেন আতঙ্কিত না হয়ে পড়ুক। আমি সেটা পছন্দ করছি। আরেক শ্বেতাঙ্গ তরুণীর বক্তব্য - অনেক ভালো কিছু তিনি করেননি, আবার যে খুব খারাপ কিছু করেছেন তাও আমি বলবো না।
ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক জো গার্সটেনসন বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় যা করছেন অধিকাংশ মার্কিনি তাতে খুশি নন। প্রেসিডেন্ট যা করছেন তা হলো প্রতিদিনের পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করে সেই মতো তিনি সাড়া দিচ্ছেন।
সর্বশেষ জনমত জরিপও বলছে, প্রতি ১০ জন মার্কিনির সাতজনই মনে করছেন কভিড-১৯ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ‘ভুল বার্তা‘ দিচ্ছেন। তবে রিপাবলিকান সমর্থকদের সিংহভাগই এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের পেছনেই রয়েছেন।
অধ্যাপক গার্সটেনসন বলেন, শুধু যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে মতামতে ভিন্নতা রয়েছে তাই নয়, এলাকা ভিত্তিতেও জনমত ভিন্ন। যে এলাকার মানুষ এই মহামারিতে মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা ক্ষিপ্ত।
বছরের শুরুর দিকে অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে জনমত জরিপে বাইডেন খুব সামান্য এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু গ্রীষ্মে ওই রাজ্যে কভিড-১৯ ভয়ঙ্কর রূপ নেয়ার পর বাইডেনের পক্ষে সমর্থন অনেক বেড়েছে। অ্যারিজোনায় করোনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে পাঁচ হাজার ৯২০ জন।
উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ২০১৬ সালের ভোটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামান্য ব্যবধানে জিতেছিলেন। এবারো বছরের অধিকাংশ সময় জুড়ে ট্রাম্পের সমর্থনে তেমন কোনো ভাটা দেখা যায়নি। কিন্তু অক্টোবর মাসে হঠাৎ সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে থাকায় জনমত ঘুরে গেছে। সর্বশেষ জনমত জরিপে উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে সাত থেকে ১৭ পয়েন্ট এগিয়ে গেছেন।
এছাড়াও যে রাজ্যটি ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিকানদের অন্যতম একটি ঘাঁটি সেই টেক্সাসেও ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পকে নিয়ে বিরূপ মনোভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। কারণ দুই দফা সংক্রমণে টেক্সাস বিপর্যস্ত। কভিডে এই রাজ্যে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৪০ জন মারা গেছে।
টেক্সাসের চিত্রশিল্পী শেন রেইলি তার রাজ্যে কভিডে এত লোকের মৃত্যুতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, জীবনে প্রথমবারের মতো এবার দল বদলিয়েছি। আমি সবসময় রক্ষণশীলদের ভোট দিয়েছি। কিন্তু এই মহামারি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানরা যা করছে তাতে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেব।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসব ক্রোধের তেমন তোয়াক্কা করছেন না। দুইদিন আগে শনিবার পেনসিলভানিয়ার নিউটন শহরে শনিবার এক সভায় তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে মশকরা করে বলেন, জো বাইডেন কি বলছেন আমি গতকাল তা দেখলাম। তার মুখে সেই একই বুলি- কভিড, কভিড আর কভিড। বলার মতো তার কাছে আর কিছু নেই।
ট্রাম্পের ওই প্রচার সভায় অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না।
শনিবার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি একটি হিসাব প্রকাশ করেছে- জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রচার সভার কারণে অতিরিক্ত ৩০ হাজারেরও বেশি লোক কভিডে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে অতিরিক্ত ৭০০ জন। অবশ্য সরেজমিনে তদন্ত নয়, বরং প্রচলিত একটি গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে তারা এই রিপোর্ট দিয়েছে।
এদিকে অধ্যাপক গার্সটেনসন মনে করেন, বহু মানুষের ভোটের সিদ্ধান্তের পেছনে করোনাভাইরাস প্যানডেমিক একমাত্র বিবেচ্য নয়। খুব কম রিপাবলিকানই, বিশেষ করে যারা দলের ঘোরতর সমর্থক, তাদের দলীয় আনুগত্য ভঙ্গ করে জো বাইডেনকে ভোট দেবেন।
তবে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে যদি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পট বদলে যায়, কভিড নিয়ন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পারফরমেন্সকেই তার প্রধান কারণ হিসাবে দেখা হবে।
পুরানো শত্রু ওবামা
করোনাভাইরাস, বাইডেন-কমলা হ্যারিসের মোকাবিলা ছাড়াও ট্রাম্পকে লড়তে হচ্ছে পুরানো শত্রু সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধেও।
ট্রাম্পের রাজনীতিতে উত্থান হয়েছিল ওবামার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প সবসময় চেষ্টা করেছেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার সাফল্য রদ করতে। ওবামার আমলে স্বাক্ষরিত ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি ও প্যারিসের জলবায়ু চুক্তি বাতিলের পেছনে নীতিগত পার্থক্যের চেয়ে ওবামার প্রতি ট্রাম্পের বিরাগিই অন্যতম কারণ বলে অনেকের ধারণা। একই কারণে ট্রাম্প এখন ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত দেশটির স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বাইডেনের পক্ষে ওবামা একেবারে শেষ সপ্তাহে নেমেছেন নির্বাচনি প্রচারে। তবে অনেকের ধারণা, শুধু বাইডেনের জন্য নয়, তিনি মঞ্চে নেমেছেন ট্রাম্পের প্রতি পুষে রাখা ক্ষোভ প্রকাশেও। পাশাপাশি তার প্রশাসনের আট বছরের অর্জনকে মনে করিয়ে দিতেও।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য ওবামা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তিনি গত এক সপ্তাহে মিশিগান, ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিয়েছেন। সেখানে তিনি ট্রাম্পের ব্যর্থতা তুলে ধরার পাশাপাশি তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও করেছেন।
এসব গুরুত্বর্পূর্ণ অঙ্গরাজ্যে ওবামার উপস্থিতি আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারদের উৎসাহিত করবে। মিশিগান-পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের এসব ভোটারদের উল্লেখযোগ্য অংশ ২০১৬ সালে ভোট দেয়নি, যা হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
এদিকে বাইডেনের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে তার দলের একাদিক শীর্ষ নেতা অংশ নিচ্ছেন। অপরদিকে ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে কোনো নামকরা রিপাবরিকান নেতা নেই। তাকে একাই সব সামলাতে হচ্ছে। -বিবিসি