যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪৮

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আজ মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) সিদ্ধান্ত নেবেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেনের মধ্যে কাকে তারা আরো চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসে দেখতে চান।
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সেদিন রাতে যে বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি হবে, সেটা খুব সহজেই আন্দাজ করা যায়। ওই রাতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচনের যেসব ফলাফল আসতে থাকবে, সেগুলোসহ আরো কিছু বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে।
প্রতিবেদনটিকে এ রকম কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো:
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের ভোট, যা পপুলার ভোট হিসেবে পরিচিত। তবে এই ভোট বেশি পাওয়ার দরকার হয় না। এর পরিবর্তে প্রার্থীরা বরং ইলেকটোরাল কলেজে বেশি ভোট পাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকেন।
গত নির্বাচনে সাধারণ জনগণের ভোট কম পেয়েও ট্রাম্প ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আগের যেকোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার প্রচুরসংখ্যক মানুষ ডাকযোগে ভোট দিচ্ছেন। এসব পোস্টাল ভোট গণনার জন্য আরো বেশি সময় লাগতে পারে ও কোনো কোনো অঙ্গরাজ্য ভোটের আগের দিন পর্যন্ত এই গণনা শুরু হবে না। ফলে কিছু অঙ্গরাজ্য থেকে ফলাফল পেতে নিশ্চিতভাবেই বিলম্ব ঘটবে।
এবার যেহেতু এত বেশিসংখ্যক মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন তাই প্রাথমিক ফলাফলে একজন প্রার্থী এগিয়ে থাকলেও পরে সেটা বদলে যেতে পারে। এ কারণে এসব সংখ্যার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে।
নির্বাচনের কিছু শব্দ বা টার্ম
বেলওয়েদার স্টেট: ওহাইও ও মিসৌরির মতো কিছু অঙ্গরাজ্যকে বেলওয়েদার স্টেট বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেখা গেছে, এসব অঙ্গরাজ্যে ভোটাররা যে প্রার্থীকে বেশি ভোট দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তিনিই জাতীয়ভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
এক্সিট পোল বা বুথফেরত সমীক্ষা: ভোটাররা ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে এলে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই সমীক্ষা পরিচালিত হয়। অল্প কিছুসংখ্যক ভোটারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তাই এই এক্সিট পোলের ফলাফলও চূড়ান্ত ফলাফল থেকে ভিন্ন হতে পারে।
ইলেকটোরাল কলেজ: প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভোটের সংখ্যা ভিন্ন। এই ভোটকে বলা হয় নির্বাচক বা ইলেকটর। অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে ওই ইলেকটরের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, যে প্রার্থী একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ী হন, তিনি ওই অঙ্গরাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যান। এই ইলেকটররা পরে একত্র হয়ে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। ইলেকটোরাল কলেজে (নির্বাচকমণ্ডলী) মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮ ও নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হতে হলে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ভোট পেতে হবে।
প্রজেকশন (ধারণা) বনাম কলিং (চূড়ান্ত): নির্বাচনের রাতে ব্যালট গণনা থেকে ধারণা বা প্রজেক্ট করা হয় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ও জাতীয়ভাবে কোনো প্রার্থী বিজয়ী হতে চলেছেন। যথেষ্ট তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোনো একটি অঙ্গরাজ্যে কে বিজয়ী হয়েছেন, সেটা ঘোষণা করা হয় না। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে আগাম ভোট, এক্সিট পোল ও নির্বাচনের দিন যেসব ভোট গণনা করা হয়- সেগুলো।
সুইং স্টেট বা ব্যাটেলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য: যেসব অঙ্গরাজ্যে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন, তা স্পষ্ট নয়, সেগুলোকে বলা হয় সুইং স্টেট বা ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেট। এর অর্থ হচ্ছে তারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যেকোনো প্রার্থীকেই বেছে নিতে পারেন।
লাল অঙ্গরাজ্য বনাম নীল অঙ্গরাজ্য: এসব অঙ্গরাজ্যে পরিষ্কার যে তারা বিশেষ কোনো একটি দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিচ্ছেন। রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন বেশি যেসব অঙ্গরাজ্যে- সেগুলো লাল ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাধান্য যেখানে- সেসব নীল।
কীভাবে জানবো কে জয়ী হচ্ছেন
যেহেতু এবার ডাকযোগে প্রচুর ভোট পড়েছে, তাই প্রাথমিক ফলাফলে কে এগিয়ে আছেন, সেটা বোঝা কঠিন হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার দ্বিগুণ পোস্টাল ভোট পড়েছে। এসব পোস্টাল ভোট কখন ও কীভাবে গণনা করা হবে, তার জন্য একেক অঙ্গরাজ্যে রয়েছে একেক ধরনের আইন। সে কারণে এসব অঙ্গরাজ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে ফলাফল পাওয়া যাবে ও কখনো কখনো সময়ের এই ব্যবধান খুব বেশিও হতে পারে। কিছু অঙ্গরাজ্য- যেমন ফ্লোরিডা ও অ্যারিজোনায় পোস্টাল ভোটের গণনা শুরু হয়ে যাবে ৩ নভেম্বরের ভোটের দিনের আগে। কিন্তু উইসকনসিন ও পেনসিলভানিয়ায় ৩ নভেম্বরের আগে সেগুলো স্পর্শ করা হবে না। ফলে সেখান থেকে ভোটের ফলাফল দেরিতে আসবে।
এখানে আরো কিছু জটিলতা আছে। পোস্টাল ভোট দেয়ার সময়সীমা একেক অঙ্গরাজ্যে একেক রকমের। কিছু অঙ্গরাজ্য- যেমন জর্জিয়ায় ৩ নভেম্বর পর্যন্ত যেসব ভোট কর্তৃপক্ষের হাতে এসে পৌঁছাবে, সেগুলো গণনা করা হবে। কিন্তু অন্যান্য অঙ্গরাজ্য- যেমন ওহাইওতে ৩ তারিখে ভোট দিলেও (অর্থাৎ খামের মধ্যে ৩ নভেম্বর সিল থাকতে হবে) সেসব ভোট গণনা করা হবে।
এটা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে কিছু অঙ্গরাজ্যের সম্পূর্ণ ফলাফল পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের নাম কখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে, সেটা আগে থেকে ধারণা করা কঠিন।
আগের নির্বাচনগুলোতে এ রকম হয়নি। ২০০৮ সালে ফলাফল পাওয়া গেছে পূর্বনির্ধারিত সময়ে। আর ২০১২ সালের ফল পাওয়া গেছে নির্ধারিত সময়ের মাত্র ১৫ মিনিট পর। ২০১৬ সালে আরো একটু দেরি হয়েছিল। পেনসিলভেনিয়ায় জয়ী হওয়ার পরই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ট্রাম্প।
পরিষ্কার করে কেউ বিজয়ী না হলে কী হবে?
৩ নভেম্বরে যদি পরিষ্কার না হয় যে কে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, তাহলে ভোট গণনা শেষ হওয়ার জন্য আমাদের আরো কয়েক দিন এমনকি কয়েক সপ্তাহও অপেক্ষা করতে হবে।
ভোটের রাতেই সব ভোট গণনা শেষ করা যায় না, যুক্তরাষ্ট্রে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এবার এই গণনা শেষ হতে আরো অনেক বেশি সময় লাগতে পারে। এর সাথে যুক্ত হতে পারে আইনগত বিরোধ। সে রকম কিছু হলে অনিশ্চয়তা আরো বাড়বে ও শেষ পর্যন্ত তাতে আদালতেরও ভূমিকা থাকতে পারে।
যেসব অঙ্গরাজ্যের ওপর নজর রাখতে হবে
নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল পেতে সময় লাগবে। তারপরও কিছু অঙ্গরাজ্যের ফলাফল থেকে আমরা হয়তো একটা ধারণা পেতে পারবো।
নর্থ ক্যারোলাইনায় ভোটগ্রহণ শেষ হবে সেখানকার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। ফলে সেখানে কেন্দ্রে পড়া ভোট গণনা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই অঙ্গরাজ্যে অল্প ভোটে জিতেছিলেন ট্রাম্প। এবার ফলাফল কোন দিকে যায়, সেটা বলা কঠিন। ফলে এই অঙ্গরাজ্যে এবার ট্রাম্প কিংবা বাইডেন, যিনি বিজয়ী হবেন, তার জন্য সেটা শুভসূচনা হতে পারে।
এর আধা ঘণ্টা পর ফ্লোরিডায় ভোট গ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় রাত ৮টায়। এটি একটি ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই অঙ্গরাজ্যে দুই দলেরই জয় পরাজয় দুটোই ঘটেছে ও এবারো সে রকম হতে পারে। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, পোস্টাল ভোট ও কেন্দ্রে পড়া ভোট, এই দুটোর গণনা প্রথম আসবে এই ফ্লোরিডা অঙ্গঅঙ্গরাজ্য থেকে। এ কারণে এই অঙ্গরাজ্যের ফলাফল বাইডেনের পক্ষে যেতে পারে।
অ্যারিজোনায় ভোটকেন্দ্র বন্ধ হবে স্থানীয় সময় রাত ৯টায়। সেখানে পোস্টাল ভোটের গণনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই অঙ্গরাজ্যে জয়লাভ করেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এবার সেখানে জনমত জরিপে বাইডেন সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। ফ্লোরিডার মতো অ্যারিজোনায়ও প্রাথমিক গণনায় বাইডেন এগিয়ে থাকতে পারেন। কারণ তার সমর্থকরা আগেই পোস্টাল ভোট দেয়ার পক্ষে ছিলেন।
বেশ কিছু ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যে ৩ নভেম্বরের আগে একটি ভোটও গণনা করা হবে না। এর অর্থ হচ্ছে- কয়েকটি ব্যাটলগ্রাউন্ডঅঙ্গরাজ্যের ফলাফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সারা দেশে যে জয়ী হচ্ছেন, সেটা বুঝতে হলে এসব অঙ্গরাজ্যের ফলাফল জানা জরুরি।
ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা শেষ হবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কর্মকর্তারা ওই রাতে প্রাথমিক কিছু ফলাফল ঘোষণা করবেন কিন্তু এর পর চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে আর কোনো ফল প্রকাশ করা হবে না। চূড়ান্ত ফলাফল হয়তো ২৮ নভেম্বর ঘোষণা করা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ওহাইও শুধু ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য নয়, কে প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, এই অঙ্গরাজ্যের ফলাফল থেকে এর আগে তার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে।
পেনসিলভেনিয়ায় ভোটকেন্দ্র বন্ধ হবে রাত ৮টায়। কে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন, তার রাস্তা তৈরিতে সাহায্য করবে এই অঙ্গরাজ্যের ফলাফল। এখানে বাইডেনের জন্ম। আবার একই সাথে ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন।
উইসকনসিন ও মিশিগানে ভোটগ্রহণ চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। আগের নির্বাচনে হিলারি উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে অল্প ভোটে পরাজিত হন। তবে এবারের কিছু জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে- বাইডেন এগিয়ে আছেন। কিন্তু লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রতিবেশী মিশিগানও আরেকটি সুইং স্টেট। সেখানে কী হয়, সেটাও দেখার বিষয়। এই অঙ্গরাজ্যে জয় পাওয়া বাইডেন ও ট্রাম্প দুটো শিবিরের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। -বিবিসি