করোনাকালেও ব্যতিক্রম দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি

রাবেয়া আশরাফী পিংকি
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪২

করোনাভাইরাস মহামারিতে পুরো বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। বেশিরভাগ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অর্থনৈতিক শ্লথগতিও জেঁকে বসেছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতির একই দশা। ব্যতিক্রম শুধু দক্ষিণ কোরিয়া। করোনাকালে যেখানে অন্য দেশের অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছে, সেখানে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা কমছে, চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রাক্কলনে দেখা গেছে, এ বছর দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম সংকুচিত হবে। চলতি বছর দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপি সংকুচিত হবে বড়জোর এক শতাংশ। চলতি বছর আর্থিক পারফরমেন্সের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে দেশটি। এর আগেই রয়েছে চীনের অবস্থান।
অন্যদিকে ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতি প্রায় আট শতাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি পুরো বছর মিলিয়ে চার শতাংশ সংকুচিত হবে।
ওইসিডির প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স বোন বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের পর বিশ্ব এই মুহূর্তে সবচেয়ে নাটকীয় অর্থনৈতিক শ্লথগতির সম্মুখীন।’
ওইসিডির প্রাক্কলন প্রতিবেদনে বলা হয়, সবার হাত ধরে এতদিন যে সফলতা আমরা দেখেছি, তা মহামারির কারণে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। তবে শুরু থেকেই মহামারির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া গা বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
বেশিরভাগ দেশ করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে দেশজুড়ে লকডাউন কর্মসূচি গ্রহণ করে। একই কৌশলে গোটা ইউরোপ মাসের পর মাস ‘প্যারালাইজড’ অবস্থায় ছিল। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া এ ধরনের পদক্ষেপ খুব একটা প্রয়োজন মনে করেনি। অর্থাৎ দেশটিতে ব্যাপকহারে শিল্পকারখানা, রেস্তোরাঁ বন্ধের মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আর এ কারণেই দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি অন্য দেশের তুলনায় খুব সহজে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
ওইসিডির দক্ষিণ কোরিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টোফ আন্দ্রে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মূল কারণ হলো- অন্যদের তুলনায় তারা অনেক ভালোভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এখানে অর্থনৈতিক ধাক্কাও তুলনামূলক কম।’
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি চাঙ্গা থাকার আরেকটি কারণ হলো- দ্রুত অর্থনৈতিক নীতিমালা সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বড় ধরনের প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও, দক্ষিণ কোরিয়ার তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। করোনাভাইরাসে আর্থিক ক্ষতির মাত্রা প্রশমিত করতে অর্থনীতিতে প্রায় ১২.১ বিলিয়ন ডলার (জিডিপির ০.৭ শতাংশের সমপরিমাণ) অর্থযোগ করেছে সিউল সরকার, যার সুবাদে দেশটির ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকরা বসন্তের শুরুতেই হাতে নগদ অর্থ পান। এছাড়া ঋণ ও গ্যারান্টি মিলিয়ে সর্বমোট প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার।
এখনো দেশটিতে প্রণোদনা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। সেপ্টেম্বরে দেশটিতে চতুর্থ দফায় প্রণোদনা ঘোষণা করে অর্থনীতিতে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করা হয়। মহামারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবসমূহ এড়িয়ে যেতে এই সম্প্রসারণ কর্মসূচি আগামী বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে দক্ষিণ কোরিয়ার নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই চমৎকার সচেতন ভূমিকার পুরো বিপরীত অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। অন্যান্য সময় এসব দেশ সাধারণত বিশালাকার আর্থিক কর্মসূচির মাধ্যমে বছর শুরু করলেও এবার সেরকম কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অব্যাহত দুর্বল অর্থনীতির মধ্যেও এখানে নগদ অর্থ সরবরাহের গতি ছিল খুবই শ্লথ। গত মাসের শুরুর দিকে মার্কিন কংগ্রেস নতুন প্রণোদনার উদ্যোগ নিলেও তা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। কংগ্রেসে সে সময় রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতারা এরইমধ্যে কমে আসা সুবিধাদি আরো কমিয়ে দেয়ার আবেদন করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বেকারদের জন্য আরও সহায়তা দাবি করে ডেমোক্র্যাটরা।
ওইসিডির আন্দ্রে বলেন, অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় আবারো চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে আর্থিক সংস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। দক্ষিণ কোরিয়ায় বছরের প্রথমার্ধে অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় কমে গেলেও আর্থিক সহায়তার কারণে তা আবার বেড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রণোদনা কর্মসূচির অর্থ জনসাধারণের কাছে এমনভাবে বণ্টন করা হয়েছে, যাতে করে সেই অর্থ পুনরায় অর্থনীতিতেই ফিরে আসে। প্রথমত, সরকার থেকে পাওয়া অর্থসহায়তা ব্যয় করতে দেশটিতে আরো ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু হয়েছে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রেতারা ব্যয় বেশি করেছে। প্রথম তিন দফায় দেয়া দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের প্রণোদনার অর্থ মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রেতারাই পেয়েছে। জনসাধারণ সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে ভোগব্যয় বাড়িয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম আরো বৃদ্ধিতে উৎসাহী হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সরকারের দেওয়া প্রণোদনার অর্থ পুনরায় অর্থনীতিতেই যোগ হবে এবং ভোগব্যয় বাড়বে- এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু প্রদেশ সৃজনশীল পদ্ধতি গ্রহণ করে। দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ জিয়ংগিও রয়েছে এর মধ্যে। প্রদেশটির গভর্নর জায়ে মিয়ং প্রদেশের বাসিন্দাদের প্রত্যেককে এক লাখ ওন বা প্রায় ৮৭ ডলার করে প্রণোদনা দেন। শর্ত দেয়া হয়- এই অর্থ তিন মাস সময়ের মধ্যে ব্যয় করতে হবে। প্রণোদনার এই পুরো অর্থ দেয়া হয় স্থানীয় মুদ্রায়, যাতে করে এই অর্থ ক্রেতারা জমিয়ে না রেখে স্থানীয় দোকানে ব্যয় করতে বাধ্য হন।
জিয়ংগিও প্রদেশের বাসিন্দা লি জং-হায়াং বলেন, ‘স্থানীয় রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়ার জন্য আমরা এই অর্থ ব্যয় করতাম।’ অন্য দেশগুলোয় যখন লকডাউনে সব স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখন দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যবসা আরো গতি পায়।
জিয়ংগিওর সেফটি প্ল্যানিং ডিভিশনের নেতা হিও ইউয়াং-জিল বলেন, ‘দুর্যোগকালীন প্রণোদনা বণ্টনের পর মাসিক বিক্রি ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বিক্রি বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন।’
প্রশ্ন জাগতে পারে- বিশ্ব যখন মহামারিতে নাকাল তখন দক্ষিণ কোরিয়ায় কি এর কোনো ছাপ পড়েনি? পড়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা আসলেও ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকতে হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়াকে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন করে ১০০ থেকে ২০০ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মাসে পুরো বছরের অর্থনীতির আউটলুক কমিয়ে ১.৩ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসে। এছাড়া বড় ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার কারণে আর্থিক ঘাটতিও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থার কথা উল্লেখ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন বলেন, ‘ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা- এই দড়ির ওপর হাঁটছে দেশ।’
সিউলের ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ লি ডোওন বলেন, ‘কোরিয়া সরকার জনসাধারণকে ভর্তুকি দিয়েছে; কিন্তু আমরা সবসময়ই তা দিয়ে যেতে পারব না। ভর্তুকির কারণে সরকারের বাজেটে ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে।’
মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি-নির্ভরশীল অর্থনীতিও ঝুঁকিতে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ লি আরো বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর খুবই নির্ভরশীল। মহামারির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য কমেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ওপরও যার প্রভাব পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে আসন্ন মাসগুলোয় পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়ে উঠবে।’