আ প্রমিজড ল্যান্ড: এক সফল রাজনীতিকের জবানবন্দি

অরুন্ধতী বসু
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২০

১৭ নভেম্বর বাজারে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার আত্মজীবনীমূলক বই ‘আ প্রমিজড ল্যান্ডে’র প্রথম খণ্ড। ৭০০ পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে তার রাজনৈতিক জীবনের নানা গল্প। দৃপ্তকণ্ঠের বাগ্মী ওবামা নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান লেখক।
‘আ প্রমিজড ল্যান্ড’ প্রকাশের প্রথম দিনই বিক্রিতে রেকর্ড গড়েছে। শুরুর কয়েকটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, ইরাকের যুদ্ধবিরোধী ভাষণের গল্প। ২০০৪ সালে ডেমোক্র্যাট ন্যাশনাল কনভেনশনের ভাষণের কথাও উল্লেখ করেছেন ওবামা। এসব ঘটনাই তাকে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর থেকে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালনের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
বইটি শেষ হয়েছে ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড ও হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ডিনারে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাধ্যমে অপমানিত হওয়ার ঘটনা দিয়ে।
ওবামা কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে কথা বলেন ও ট্রাম্প সবসময় শ্বেতাঙ্গদের গুরুত্ব দেন- এটি এই দুই ব্যক্তির বৈপরীত্যের কারণ নয়। কারণ ওবামা সবসময় যেকোনো ইস্যুতে দুই পক্ষের মতামতেরই গুরুত্ব দিয়ে তা মধ্যস্থতার মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ট্রাম্পের এমন ধৈর্য্য বা সহনশীলতা- কোনোটিই নেই।
ওবামা সবসময় প্রতিটি যুক্তিতর্কে নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতেন। তার অবস্থান ছিল আশাবাদ ও আশঙ্কা; আদর্শবাদ ও বাস্তববাদ; নীতি ও স্বার্থের মাঝামাঝি। তার সুদৃষ্টিতে ছিল বাড়ির মালিক থেকে ব্যাংকার, সেনা কমান্ডার, বিক্ষোভকারী, পুলিশ, তরুণ পরামর্শদাতা ও প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। সবার কথাই ভাবতেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট। একই মনোভাব দেখা গেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ওবামা ইউরোপীয় ও চীনাদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেছেন। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব বজায় রাখার চেষ্টা ছিল তার।
সতর্কতার সঙ্গে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের পক্ষে সমর্থন দিয়ে মৃত সেনাদের শোকাতুর পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি লেখার চেষ্টা করেছেন। এখানে পরিচয় মেলে মানবিক ওবামার। দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম দুই বছরের প্রতিশ্রুতি ও বিপজ্জনক অবস্থানের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে নিজ প্রশাসনের প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন। অন্যদিকে ২০১০ সালে মধ্য-মেয়াদি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের জন্য নিজেকেই দোষারোপ করেন। এ বিষয়ে লেখেন- ‘প্রতিভার অভাব হোক বা বিরোধী পক্ষের সৌভাগ্য- আমি হিসেবে জাতিকে একাত্ম করতে ব্যর্থ হয়েছি। এর পেছনে কারণ- যা সঠিক বলে জানতাম, আমি তা-ই করেছি, এটিই প্রমাণ হলো’। সমালোচকরা তার রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণকে কোনো সুবিধাবাদীর স্মৃতি হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারেন; কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই স্মৃতিচারণ তার প্রকাশিত বাস্তববাদের চিরন্তন রূপ।
আ প্রমিজড ল্যান্ড বইটিতে ওবামা দাবি করেছেন, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ও ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট তাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। ওবামা মনে করেন, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিকে শাসনের মধ্য দিয়ে তিনি আমেরিকায় একটি রূপান্তরের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ওবামা স্বীকার করেছেন, ওভাল অফিসে থাকাকালে একজন প্রেসিডেন্ট কেবল কয়েকটি নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নয়।
তিনি বইয়ে লিখেছেন, মাত্র দুই বছরে সিনেটর থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার সময়টুকুতে রাাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও যোগ্য রাজনৈতিক সহযোগীর অভাব বোধ করেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় শৈশব কেটেছে ওবামার। সেই সময় বিশ্ব সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভেবেছিলেন, কঠোর পরিশ্রম ও নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে জ্ঞানের অভাব পূরণ করতে পারবেন; কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই আমেরিকার রাজনৈতিক অবস্থান একপেশে হয়ে পড়েছিল ডানপন্থার দিকে। এতে দেশটির সামাজিক, রাজনৈতিক ও বর্ণগত বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। তেমনিভাবে গঠন হয়েছে বিদেশ নীতি। ওবামা বলেছেন, তিনি যুদ্ধভাবাপন্ন মানসিকতার অবসান ঘটাতে এসেছিলেন; কিন্তু ক্যাবিনেট সদস্যসহ, সামরিক ও বেসামরিক যুদ্ধংদেহি মনোভাবে হতাশ হয়েছেন।
ওবামা স্বীকার করেছেন, আমেরিকা একটি শ্বেতাঙ্গ প্রভাবাধীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘেরাটোপে আবদ্ধ। গভীর সাংস্কৃতিক ও বর্ণগত জটিলতা এখানে বিদ্যমান। এ অবস্থা অভিবাসী ও বিদেশির জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বইটিতে আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে দেয়া ওবামার বার্তাগুলো হোয়াইট হাউসে তিনি থাকাকালে কখনো উচ্চারিত হয়নি। যেমন- তিনি লিখেছেন, বোস্টনে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ওপর পুলিশ সদস্যের আক্রমণকে ‘স্টুপিড’ বলেছিলেন। এরপরই তার জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল।
এ ঘটনা ওবামাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, ‘আমাদের জাতির সামাজিক শৃঙ্খলার ভীত কখনো ঐকমত্যের ভিত্তিতে ছিল না। কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্বেতাঙ্গদের সহিংসতা প্রকাশ হয়ে আসছে বহু শতাব্দী ধরে। অথবা ২০১০ সালে যখন ডিপওয়াটার হরাইজনে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে। ওবামা বলেছেন, ‘আমরা আমেরিকানরা পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার চেয়ে সস্তা গ্যাস ও আমাদের বড় গাড়িগুলো বেশি পছন্দ করি।’ ওবামার দ্য প্রমিজড ল্যান্ডে রয়েছে তার রাজনৈতিক সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের কাহিনীও।
২০০৯ সালের জুন। মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে শুরু করলেন, ‘আস-সালামু ওয়ালায়কুম’ দিয়ে। এ উক্তি শুনে আরব ও মুসলিম বিশ্বের অবস্থা হয়েছিল জেরি ম্যাগুয়ের সিনেমার ডরোথির মতো। ওই সিনেমার একটি চরিত্র ডরোথি প্রধান চরিত্র জেরিকে আবেগপ্লুত হয়ে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে হ্যালো বলেছ!’ কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মুসলিম বিশ্বের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের মানবিক করে তুলছেন- বিষয়টি খুবই ইতিবাচক ছিল; কিন্তু প্রতিটি ইস্যুতেই সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন তিনি। সমালোচকরা তার এই সফরকে অভিহিত করেছিলেন, ‘ক্ষমা প্রার্থনার সফর’ বলে। বক্তা হিসেবে ওবামার জুড়ি নেই। আইডিয়ার ঘেরাটোপে সবাইকে মাত করতে পছন্দ করেন। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়ার ইচ্ছে ব্যতীত মুসলিম বিশ্বকে ছোট ছেলে ভোলানো কথা বলা তার উচিত হয়নি। বইয়ে ওবামা একাধিকবার বলেছেন, অনেকের প্রত্যাশা তার কাছে খুব বেশি। তারাই তার কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করেন।
যখন ওবামা সক্রিয় ছিলেন, তখন অনেক ইস্যুই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। যেমন- রাশিয়ার সাথে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করেছিলেন। অথবা কোপেনহেগেনে চীন ও ইউরোপের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা তৈরিতে চীন নেতৃত্বাধীন জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈঠক বাচাল করে দিয়েছিলেন; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অন্তহীন যুদ্ধ অবসান ও এর পেছনে থাকা মানসিকতা দূরীকরণে তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নকালে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।
ওবামা বলেন, তাকে ভুল বোঝা হয়েছে। অন্য বাস্তববাদী আমেরিকানদের মতো তিনি ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন; কিন্তু আফগান যুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়। আরও বলেন, তিনি শান্তিবাদী নন, যিনি বিশ্বাস করেন- কূটনীতি দিয়ে সব সমস্যা সমাধান করা যায়। আফগানিস্তানে ওবামা সেনা কম মোতায়েন করতে চাইলে পেন্টাগন তার বিরোধিতা করত। ফলে সেনা প্রধানদের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য হয়েছিলেন সেসময়। আ প্রমিজড ল্যান্ড বইয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভুয়সী প্রশংসা করেছেন ওবামা; কিন্তু নেতানিয়াহুকে একেবারেই পছন্দ করেন না তিনি। এমনকি তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু প্রচারণা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন ওবামা। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে এ ঘটনায় নিন্দা করার পরিবর্তে তাদের ছত্রছায়ায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তিনি বইয়ে দাবি করেছেন, ‘ইসরায়েলের নীতির সমালোচকদের ‘ইসরায়েলবিরোধী’ (এবং সম্ভবত অ্যান্টি-সেমিটিক) হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এবং পরের নির্বাচনে মোটা অর্থায়নের প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছেন।’ কেউ কেউ এরই মধ্যে ওবামার দাবিকে অ্যান্টি সেমিটিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা অনুমানযোগ্য। বইয়ে ওবামা লিখেছেন, আরব বসন্তের সময় কীভাবে প্রতিবাদীদের ‘হ্যাঁ, আমরা পারি’ মনোভাবের মাধ্যমে আবিষ্ট হয়েছিলেন। সেসময় তিনি ক্যাবিনেটের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং সৌদি ও আমিরাতি নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাবিনেট সদস্য ও সৌদি-আমিরাতি নেতারা বলেছিলেন, তার এ সিদ্ধান্তে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে আমেরিকা। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের খবর পেয়েও তাতে হস্তক্ষেপ করার অভিপ্রায় ছিল ওবামার।
প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট গেটসের পরামর্শের বিরোধিতা জানিয়ে নিজ থেকে কাজ করার সিদ্ধান্তও নেন; কিন্তু তার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হয়নি, এটাই ব্যর্থতা। বিরোধীরা পদক্ষেপ নেয়ায় তার আগের অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে গোটা অঞ্চলে। আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন স্থগিত করে দেন। প্রত্যাশার পরিবর্তে বেছে নেন ক্ষোভ।
হতাশার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালে নতুন বিদেশনীতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ালেন ওবামা। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তখন মোহ কেটেছে তার। এ অঞ্চলেও তাকে নিয়ে হতাশ অনেকেই। অনেক ইস্যুতেই ওবামা ভুল। তবে মুসলিম বিশ্বকে অসন্তোষের মূল কারণ অনুসন্ধানের পরামর্শটুকু সঠিকই দিয়েছিলেন তিনি।
(আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনীতি বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারার নিবন্ধ অবলম্বনে)