
কৃষক আন্দোলন। ফাইল ছবি
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে ও ক্ষেত্রে অসন্তোষ তৈরি হয়। তবে ২০১৯ সালের ভোটে নিরঙ্কুশ ব্যবধানে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মোদি সরকার হয়ে ওঠে আরো বেশি আগ্রাসী।
নির্বাহী বিভাগ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এমনকি বিচার বিভাগেও দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে। নাগরিকপঞ্জি, সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইন, তিন তালাক, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর আসে বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির গড়ার পক্ষে সর্বোচ্চ আদালতের রায়- একের পর এক বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে যে উগ্র-সাম্প্রদায়িক বিভক্তি রচিত হয়, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে।
নাগরিকপঞ্জি, সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সঙ্গী করে ২০২০ সালে প্রবেশ করে ভারত।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের প্রতি দিল্লির নির্বাচনি প্রচারণার সময়কাল থেকেই বিষোদ্গার করে আসছিল ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা সংঘবদ্ধ মুসলিমবিদ্বেষী সহিংসতায় অন্তত ৫৩ জন নিহত হন। আহত দুই শতাধিক। এ সংঘবদ্ধ হিন্দুত্ববাদী সহিংসতায় অন্তত কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, হাজারো মানুষের জীবন রাতারাতি বদলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৩০ জানুয়ারি ভারতে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। প্রথমে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন পদক্ষেপ না নিলেও ২৩ মার্চ মধ্যরাতে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা করে। মে মাস পর্যন্ত এ লকডাউন বলবৎ থাকে। এরপর ধীরে ধীরে তা শিথিল করা হয়। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বড় শহরগুলোতে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা। বাস-ট্রেনসহ সব গণপরিবহন চলাচল যখন বন্ধ, তখন অভুক্ত শ্রমিকরা শতশত মাইল হেঁটে বাড়ির পথে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে তাদের লকডাউনের নামে আটকানো হয়, নির্যাতনের শিকার হন অনেকে। দীর্ঘ হাঁটাপথে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে সমালোচনা হলেও কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
আগে থেকেই ধুঁকে ধুঁকে চলা ভারতের অর্থনীতি করোনাকালে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে পড়েছে। এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে (কোয়ার্টার) ভারতের অর্থনীতি নজিরবিহীনভাবে ২৩.৯ শতাংশ সংকোচিত হয়, যা ভারতের স্বাধীনতার পর কখনো হয়নি। ভারতের সাবেক প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের মতে, এই সংকোচনের পরিমাণ ছিল ৩২ শতাংশ। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই পরিমাণটি ছিল আরো বেশি।
ভারত-চীনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হন। জুন-জুলাইয়ে ভারতজুড়ে চীনবিরোধী ঢেউ বয়ে যায়। চীনের বিপক্ষে পদক্ষেপ হিসেবে টিকটকসহ ৫৯টি চীনা অ্যাপস নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। ভারতের বন্দরগুলোতেও চীনা পণ্য খালাসে বিলম্ব করা হয়। এমন অবস্থায় চীনের স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলো ভারতে বিনিয়োগ স্থগিত রেখেছে। ফলে ভারতের শ্রমবাজার আরো নাজুক হয়ে পড়ে।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বিজেপিকে বর্তমানে পার্লামেন্টে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে, তার সাথে কেবল ১৯৪৭ সালের কংগ্রেস পার্টির তুলনা চলে। আর এ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ভারত রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী মতাদর্শ আকারে হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করছে। মোদি সরকার দ্বিতীয়বার দিল্লিতে আসীন হওয়ার পর বাবরি মসজিদ মামলা প্রচলিত ধীরগতি কাটিয়ে গতি অর্জন করে, প্রায় প্রতিদিনই শুনানি চলে। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বাবরি মসজিদ মামলার চূড়ান্ত রায়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জমিতে একটি মন্দির নির্মাণের নির্দেশনা দেন। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট হিন্দুত্ব সন্ত্রাসে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদে রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেন নরেন্দ্র মোদি।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় কৃষক আন্দোলন হয়েছে ভারতে, যার মূল কেন্দ্র ছিল উত্তর ভারতের পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো জায়গাগুলো। কৃষকের ক্ষত-বিক্ষত পায়ের ছবি দেশব্যাপী সাড়া জাগিয়েছিল। এসব আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ঋণ মওকুফ। তবে এবারের কৃষক আন্দোলন পুঞ্জিভূত হয়েছে মূলত তিনটি কৃষি আইন পাস হওয়াকে কেন্দ্র করে। গত সেপ্টেম্বরে প্রায় গায়ের জোরে কোনো আলোচনা ছাড়াই বিজেপি সরকার তিনটি কৃষি বিল পাস করিয়েছে। এসব কৃষি আইনের বয়ান অনুযায়ী, যে কোনো বড় ব্যবসায়ী সংস্থা, হোলসেলার, রিটেইলার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনতে পারবে। এতদিন কৃষকরা সরকার-নিয়ন্ত্রিত মান্ডিতে ফসল বিক্রি করতে পারতেন। সরকারি কিষাণ মান্ডিতে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেয়া হতো, যাতে ফসল বিক্রি করে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হওয়ার ভয় ছিল না। সরকার নিজ দায়িত্বে মান্ডিতে এই ব্যবস্থা কার্যকর করে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া নিশ্চিত করত। আর মান্ডি থেকে ফসল কিনে বাজারজাত করতে পারত কেবল লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা। এজন্য নির্ধারিত ফি দিতে হতো সরকারকে। অর্থাৎ কৃষক সুরক্ষার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখত সরকার।
নতুন আইনের ফলে বৃহৎ করপোরেট গোষ্ঠী খোলা ছাড় পেয়েছে। মান্ডির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব কমিয়ে ফসল বিক্রির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বাজারের হাতে। বাজারে ফসলের দামের ওঠা-নামায় ন্যূনতম মূল্যের নিশ্চয়তা আর থাকছে না। এমএসপি বন্ধের কথা ওই আইনে বলা হয়নি; কিন্তু মান্ডির বাইরে ফসল বিক্রি উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি কার্যত বন্ধ করার দিকেই এগিয়েছে সরকার-এমনটিই মনে করছেন আন্দোলনরত কৃষকরা।
অপর একটি আইনে বলা হয়, চুক্তিভিত্তিক চাষকে আইনি স্বীকৃতি দেয়া হয়। অর্থাৎ, কোনো বৃহৎ করপোরেট বা বহুজাতিক কোম্পানি পূর্বনির্ধারিত মূল্যে চুক্তিভিত্তিক চাষ করাতে পারবে। আবার দানাশস্য, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজের মতো ফসলকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে’র তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখন থেকে এসব পণ্যের ব্যবসা, মজুদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।
বছর যখন শেষ হচ্ছে, তখনো আন্দোলনরত কৃষকরা দিল্লি সীমান্তে। এরসাথে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একাত্ম হচ্ছেন। তীব্র ঠান্ডা ও অন্যান্য রোগে আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে অন্তত ৩৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে কিছুতেই কৃষকরা পিছু হটছেন না। এ আন্দোলন আরো দীর্ঘায়িত হলে, তা ২০২১ সালে রাজনৈতিক সংকটকে আরও তীব্র করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এক মাইলফলক। এর আগে যেকোনো বড় আন্দোলনে মিডিয়া প্রধানত সরকারের দিকেই প্রশ্ন তুলত; কিন্তু গত ছয় বছরে যেকোনো বিক্ষোভে আন্দোলনকারীদের দিকে প্রশ্ন তোলা হয়- তারা কেন ও কাদের স্বার্থে বিভ্রান্ত হয়ে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এর আগেও কোনো কোনো মিডিয়া সরকারপন্থী অবস্থান নিতে দেখা গেছে, তবে তার একটি সীমাবদ্ধ রূপ ছিল। এখন বেশিরভাগ মিডিয়াই মোদি সরকারের অঘোষিত মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে।
ছাত্র আন্দোলনকে চিত্রায়িত করা হয় বিরোধী পক্ষের উস্কানি হিসেবে; নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠলে, দেখানো হয়- এটি কথিত ‘আরবান নকশাল’ ও ‘উদারতাবাদী’দের আন্দোলন; ডাক্তারদের আন্দোলনে বলা হয়- আন্দোলনকারীদের ‘বিভ্রান্ত’ করা হচ্ছে। এবারের কৃষক আন্দোলনের মিডিয়া কাভারেজে তা আরো একবার প্রমাণিত হলো।
এনডিটিভি অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভারতীয় ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বলেন, ‘ইন্দিরার মতো মোদিও চান মিডিয়া দিনভর শুধু তারই গুণকীর্তন গাইবে, আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিষোদ্গার ও তাদের বিরুদ্ধে ‘অনুসন্ধানী’ প্রতিবেদন করবে। একইভাবে তিনি বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণে এনেছেন; পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং বিভিন্ন বিতর্কিত আইন প্রবর্তন ও পরিবর্তন করেছেন; গবেষণার বিষয়ে পরিবর্তন এনেছেন; স্কুল-কলেজের সিলেবাস পরিবর্তন করেছেন।
শুধু তা-ই নয়, এতদিন যেসব প্রতিষ্ঠান অনেকাংশেই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল, সেগুলোও তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশন। পার্টি, সরকার ও রাষ্ট্রে নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি- যেখানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই সরকারের ইচ্ছা, সরকারের ইচ্ছাই পার্টির ও পার্টির ইচ্ছাই রাষ্ট্রীয় আকাক্ষায় পরিণত হয়।’
কার্যত ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, অথবা দলীয়করণের মাধ্যমে ‘এক ব্যক্তি, এক পার্টি, এক দেশ, এক নীতি’র ধারণাই প্রবর্তন করা হচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।