Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ক্ষমতার শেষ মুহূর্তেও চীন-বিরোধী ট্রাম্প

Icon

রাবেয়া আশরাফী পিংকি

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৯

ক্ষমতার শেষ মুহূর্তেও চীন-বিরোধী ট্রাম্প

জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছাড়তে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা ত্যাগের শেষ মুহূর্তে এসেও চীনকে একহাত দেখে নিতে ভুল করছেন না তিনি। 

চীনা কোম্পানিগুলোকে মার্কিন শেয়ারবাজারের তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ, জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে ৬০টি চীনা কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও মুদ্রা কারসাজি করে এমন দেশের তালিকা থেকে চীনের নাম তুলে নেয়া হলেও দেশটিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

ট্রাম্পের গৃহীত সাম্প্রতিক এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বৈরী সম্পর্ককে আরো তিক্ত করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন একটি বিলে সই করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে- চীনা কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক হিসাবপত্র মার্কিন রেগুলেটরদের কাছে প্রকাশ না করলে তাদের ওয়ালস্ট্রিট (মার্কিন পুঁজি বাজার) থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ পদক্ষেপে আলিবাবা, বাইদুর মতো করপোরেট জায়ান্টরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যায় বাণিজ্য চর্চার অভিযোগ এনে দীর্ঘদিন ধরেই চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন ট্রাম্প। দেশটি থেকে আমদানি করা কোটি কোটি ডলারের পণ্যে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে এর মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি ট্রাম্প এ বছর তুলেছেন। বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার জন্য বেইজিংকেই দোষারোপ করেছেন তিনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জো বাইডেনের কাছে হেরে যাওয়ার পেছনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাই অন্যতম ভূমিকা রেখেছে।

চীনের সাথে চলমান তিক্ত সম্পর্কের মধ্যেই চীনা কোম্পানিগুলোকে মার্কিন শেয়ারবাজার থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে ট্রাম্প সরকার। এই আইনটি গত মে মাসে সিনেট সদস্যদের অনুমোদন পাওয়ার পর চলতি মাসের শুরুতে সহজেই হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে দ্বিপক্ষীয় সমর্থন অর্জন করে। আইনটি বিদেশি যে কোনো কোম্পানির ওপর প্রয়োগ প্রযোজ্য হলেও মূলত চীনা কোম্পানিগুলোকেই নিশানা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। চীনের কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় তহবিলের অংশ হিসেবে বহুবছর ধরেই আমেরিকার পুঁজি বাজার এবং ডলারভিত্তিক অর্থায়ন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে আসছে। এসব কোম্পানিকেই এখন তাদের আর্থিক বিবরণী রেগুলেটরদের কাছে তুলে ধরতে বাধ্য করতে আইনে বেশ কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন- টানা তিন বছর আইন অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে এবং অডিটের নির্ধারিত মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর ক্ষতিকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। 

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করে আসা চীনা কোম্পানিগুলোর হিসাবপত্র পরীক্ষার দায়িত্ব অনেক বছর ধরেই পাবলিক কোম্পানি অ্যাকাউন্টিং ওভারসাইট বোর্ডকে (পিসিএওবি) দিতে চাইছে দেশটি; কিন্তু চীনের আপত্তির কারণে এ বিষয়টি নিয়ে বহুবছর ধরেই দু’দেশের মধ্যে বিবাদ চলছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি এনরন করপোরেশনের অ্যাকাউন্টিং কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সুরক্ষায় পিসিএওবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থার আওতায় কোম্পানিগুলোকে তাদের আর্থিক হিসাবপত্র পর্যালোচনার জন্য পরিদর্শকদের অনুমোদন দেয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাদের দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কি-না, সে তথ্যও প্রকাশে বাধ্য করা হয়। মার্কিন এক্সচেঞ্জের সব কোম্পানি একই নীতিমালা মেনে চলবে, তা এ আইনটি নিশ্চিত করবে। ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ওপর আইনটি প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসইসির চেয়ারম্যান জয় ক্লেটন চলতি বছরের শেষে পদত্যাগের আগেই এই আইনটির প্রস্তাব উত্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যেসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের অডিট নীতিমালা মেনে চলবে না তাদের শেয়ারবাজারের তালিকাচ্যুত করা হবে এ আইনের মাধ্যমে। 

চীনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, যা অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ ভিসা দেয়া সীমিত করা হয়েছে। এই সদস্যদের মধ্যকার কারও কারও ১০ বছরের ভিসার মেয়াদ কমিয়ে মাত্র একমাস করা হয়েছে।

অন্যদিকে, মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত’ রাখার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে এমন ধারণা থেকে চীনের ৬০টি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (এসএমআইসি), ড্রোন নির্মাতা এসজেড ডিজেআই টেকনোলজিসহ মোট ৬০টি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এসএমআইসির কার্যক্রম থাকার পরই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কালো তালিকাভুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামরিকীকরণ এবং দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের মালিকানা দাবিতে সমর্থন দেয়া, পিপলস লিবারেশন আর্মির কর্মসূচিতে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের গোপন তথ্য চুরিতে সহযোগিতা করার মতো অভিযোগ রয়েছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ডিজেআই অথবা শেনজেন ডিজেআই সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজিস কীভাবে নজরদারি রাষ্ট্র এবং সামগ্রিক দমনের অংশ হয়ে উঠেছে তার পক্ষে প্রচুর কাগজপত্র রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে নিষিদ্ধ হওয়া কেম্পানির মধ্যে বেশিরভাগই চীনের। এসব কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস কোম্পানির মতো পরিণতি বরণ করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে চীনা শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিকে হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন থেকেই মার্কিন সফটওয়্যার থেকে সার্কিট সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কালো তালিকাভুক্তির পর থেকে সাময়িক লাইসেন্সের মাধ্যমে হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও চলতি বছরের আগস্টের পর থেকে কোম্পানিটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। 

বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতির দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিবাদের অন্যতম বলি চীনের এই হুয়াওয়ে এবং এসএমআইসি। জানুয়ারিতে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পদে থাকবেন ট্রাম্প। এ সময়ের মধ্যে ট্রাম্প যে চীনের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন সে বিষয়ে অনেকেরই ধারণা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এমন একের পর এক নিষেধাজ্ঞাকে ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার দোহাই দিয়ে’ চীনের কোম্পানিগুলোকে চাপে রাখার চেষ্টা বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছেন। 

সাংহাইভিত্তিক এসএমআইসি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোয়ালকম ইনকরপোরেশন এবং ব্রডকম ইনকরপোরেশনকে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। বিশ্বমানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি আমেরিকান প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। দেশটির এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই এসএমআইসি। প্রযুক্তি খাত নিয়ে চীনের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যকে সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ জন্যই চীনের কোম্পানিগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এসএমআইসির দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন এখন ব্যর্থ হওয়ার পথে। এ ছাড়া যেসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে এসএমআইসির কাছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রফতানি করে থাকে তারাও এখন অনিশ্চয়তায় রয়েছে। 

অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ ফরেন-এক্সচেঞ্জ প্রতিবেদনে মুদ্রা কারসাজিকারক হিসেবে প্রথমবারের মতো সুইজারল্যান্ড ও ভিয়েতনামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া চীনের নাম আগে এই তালিকাভুক্ত থাকলেও নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে তা আর থাকছে না। তবে দেশটিকে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে। এ ছাড়া চীনকে তাদের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ‘আরও স্বচ্ছ’ করার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পর্ক আরও মজবুত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫