Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ব্রেক্সিট হাওয়ায় স্বাধীনতার পথে স্কটল্যান্ড

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:৫৭

ব্রেক্সিট হাওয়ায় স্বাধীনতার পথে স্কটল্যান্ড

ব্রেক্সিট প্রশ্নে যখন ব্রিটেনের সরকার টালমাটাল, তখনই স্বাধীনতার জন্য গণভোটের ঘোষণা দিলেন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন। গত ১৩ অক্টোবর  ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় গণভোট আয়োজন করা হবে। জনমত জরিপে জানা যায়, স্বাধীনতার পক্ষে ৫০ শতাংশেরও বেশি স্কটিশের সমর্থন রয়েছে, যা ২০১৪ সালে আয়োজিত প্রথম গণভোটের চেয়ে ৫ পয়েন্ট বেশি। 

প্রসঙ্গত, ব্রেক্সিট ইস্যুতে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে চলতি বছরের মে মাসে পদত্যাগের ঘোষণা দেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তিনি সরে দাঁড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রী হন কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি কনজারভেটিভ নেতা বরিস জনসন। নির্বাচিত হওয়ার পর আগামী ৩১ অক্টোবর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন তিনি। 

গত ২২ অক্টোবর বরিস জনসন সরকার প্রস্তাবিত ১১৫ পৃষ্ঠার ব্রেক্সিট চুক্তির খসড়া হাউস অব কমন্সে উত্থাপন করা হলে তা আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। আালোচনার পক্ষে ৩২৯টি ভোট পড়ে, বিপক্ষে ভোট পড়ে ২৯৯টি। পার্লামেন্ট আলোচনার পক্ষে অবস্থান নিলেও জনসনের পক্ষ থেকে আলোচনা তিন দিনের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার যে প্রস্তাব তোলা হয়, তা ৩২২-২০৮ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। ভোটাভুটির পর জনসন বলেন, এমপিরা আরও দেরি করিয়ে দেওয়ায় তিনি হতাশ। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরবর্তী পদক্ষেপ দেখা পর্যন্ত তিনি তার ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া স্থগিত রাখবেন। জনসন আশা করছেন, ইইউ আগামী জানুয়ারির শেষ নাগাদ ব্রেক্সিট প্রলম্বিত করতে সম্মত হবে। ফলে আগামী ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতে প্রস্তাব করেন তিনি। এতে বিরোধী দল লেবার পার্টি সমর্থন দিলে ওই বিল পাস হয়।

ব্রেক্সিট ডেডলাইন

২০১৬ সালের জুনে ব্রেক্সিট গণভোটের পর থেকেই স্কটিশদের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন বাড়ছে। তখন স্কটিশ ভোটারদের বেশিরভাগই গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তবে যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ ভোটার ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। স্কটল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পার্টি এসএনপির দাবি, ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাজ্যের সরকার স্কটিশ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ২০১৪ সালের গণভোটের সময় যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিলে ইইউতে স্কটল্যান্ড থাকতে পারবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এবার স্কটিশ জনগণের আকাক্সক্ষার তোয়াক্কা না করেই তাদের ইইউ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। 

বরিস জনসন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর স্কটিশদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। অভিজাত কট্টর রক্ষণশীল অবস্থানের কারণেই স্কটিশরা তাকে পছন্দ করেন না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় তিনি শুধু স্কটিশ জনগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা থেকেই বিরত থাকেননি, তিনি ফার্স্ট মিনিস্টারের বাড়ি থেকেও পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছিলেন। কারণ তখন ওই বাড়ির মূল ফটকের সামনে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছিল। এটা এখনো নিশ্চিত নয় বরিস জনসন নতুন করে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটের পক্ষে মত দেবেন কি না। তবে এরই মধ্যে তিনি নতুন গণভোটের প্রশ্নে সমর্থন না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। 

গণভোটে সমর্থন না দিলে যুক্তরাজ্য সরকার সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে। জাতীয়তাবাদীরা অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। প্রত্যেক সপ্তাহেই তারা দ্বিতীয় গণভোটের পক্ষে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। এমনকি তারা আরও আগেই কেন গণভোট আহ্বান করছেন না, সেজন্য নিকোলা স্টারজনকে দোষারোপ করছে। জনসন তাদের দাবি না মানলে, বর্তমান অস্থির অবস্থায় আগুনে ঘি ঢালার কাজ করবে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে স্কটিশদের আন্দোলন এখনো অহিংস হলেও, জনসন সরকার গণভোটে বাধা দিলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। কাতালোনিয়ার মতো অবস্থা স্কটল্যান্ডেও হতে পারে। উল্লেখ্য, কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় আসলেও স্পেনের সরকার তা মেনে নেয়নি। তারা কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে এবং স্বাধীনতাপন্থী নেতাদের কারাবন্দি করে। 

স্কটল্যান্ডের এ অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে কোনো কোনো বিশ্লেষক সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল চিন্তারও অতীত। ব্রেক্সিট সেই চিন্তার দেয়ালে ফাটল ধরিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ও আইনি বৈধতাকেই। যুক্তরাজ্যের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। কিন্তু অতীতে বোঝাপড়া ও আইনি আনুগত্যের কারণে এটি নিয়ে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে এবার ওই লিখিত সংবিধান না থাকার বিষয়টিকে যেভাবে সরকার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, তেমনটা আগে কখনো হয়নি। 

যুক্তরাজ্য নিয়ে অসন্তোষ শুধু স্কটল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ নয়। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে এতে যুক্ত হতে পারে ওয়েলস। সেখানে নাটকীয়ভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে। স্কটল্যান্ডে প্রথম গণভোটের সময় দেখা গিয়েছিল, ওয়েলসে স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন ৩ শতাংশের বেশি নয়। অথচ সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা যায়, ব্রেক্সিটের প্রভাবে ওয়েলসের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগণ আর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতে চাইছেন না। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থকদের অবস্থান। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব স্থানে ওয়েলসের আদিনিবাসীদের বাস, সেসব এলাকা ইইউতে থাকার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। আবার যেসব এলাকায় জাতিগতভাবে ইংলিশরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব এলাকা ব্রেক্সিটের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। ওয়েলসের আদিনিবাসীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিচ্ছে ইংরেজ সেটেলাররা। আর এজন্যই স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। 

চুক্তি হোক বা না হোক, ব্রেক্সিট যে হচ্ছে, এটুকু মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর তার বিপরীতে ৩০০ বছরের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতেই স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে স্কটল্যান্ড। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মূলধারার কোনো পার্টিই স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা মেনে নিতে রাজি নয়। অথচ ব্রেক্সিটের হাওয়ায় স্কটিশ জাতীয়তাবাদ যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তা হয়তো যুক্তরাজ্যের সঙ্গে পূর্ণ অনাস্থা রচনা করবে। স্বাধীনতা আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেবে। এমন অবস্থায় সহিংসতা হয়ে উঠতে পারে নির্মম বাস্তবতা।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫