মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৪১

১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। তবে তা না হয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচিসহ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে জয়লাভ করে সুচির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দাবি- নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। তবে মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন কারচুপির অভিযোগ বাতিল করে দেয়।
নির্বাচনে এনএলডি ২২৪টি আসনের মধ্যে ১৩৮টিতে জয় লাভ করে। বাকি সব দল মিলিয়ে পায় মাত্র ৩০টি আসন।
২০০৮ সালে সামরিক বাহিনীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে রচিত সংবিধান অনুযায়ী ৫৬টি আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকে। ২০১৯ সালে এনএলডি সংবিধানে পরিবর্তন আনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে লাগবে ৭৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা ২৫ শতাংশ আসন বাদে সব আসনই একটি দলকে পেতে হবে। তবে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) মাত্র ৩০টি আসন পেলেও তা সংবিধান পরিবর্তন রুখে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সংবিধানের ৪১৭ ও ৪১৮ অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে ক্ষমতা দখল করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এই অভ্যুত্থানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, অনেকেই এই অভ্যুত্থানে অবাক হয়েছেন। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল। স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছাড়াও দুইজন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন সামরিক বাহিনী থেকে আসত। কারও কারও মতে, ২০১১ সাল থেকে সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকা সিনিয়র জেনারেল মিং অং হিয়াংয়ের অবসরের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে অভ্যুত্থানের সম্পর্ক থাকতে পারে।
মার্কিন নীতি-নির্ধারণী গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) এক লেখায় বলা হয়, সুচি কার্যত মিয়ানমারের বেসামরিক প্রধানই ছিলেন। নিজের দলের মাঝে তার ক্ষমতা ছিল একচ্ছত্র ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা তিনি করেননি। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা তো তিনি করেনইনি, বরং সামরিক বাহিনীর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনকে তিনি সমর্থন করে গেছেন। মিয়ানমারের মিডিয়ার স্বাধীনতাকেও তিনি দমিয়ে রেখেছিলেন। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানকে তিনি সমর্থন করে গেছেন। তবে অভ্যুত্থানের কারণে এনএলডির নেতৃত্বে জনগণের মাঝে অসন্তোষ যেমন দানা বেঁধে উঠতে পারে, তেমনি দেশটির বহু জাতিগত বিরোধ থামাতে স্বাক্ষরিত চুক্তিও ভেস্তে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর অত্যাচারকে সমর্থন করে সুচি তার নোবেল বিজয়ী পরিচয়কে ধ্বংস করেছেন। সাবেক মার্কিন কূটনীতিবিদ বিল রিচার্ডসন এক বার্তায় বলেন, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক চিন্তাগুলো এগিয়ে নিতে ব্যর্থতার কারণে সুচির উচিত অন্য কারও হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। তবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সুচিকে সমর্থন করে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে অবরোধ দেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ জানান, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা না ছাড়লে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের উচিত মিয়ানমারের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করা।
সিএফআর জানায়, পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তেমন কঠোর ভাষায় কথা বলছে না। চীন ও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই মিয়ানমারকে স্থিতিশীল দেখতে চায় বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশ আশা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন। একইসাথে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুচি স্টেট কাউন্সিলর থাকার সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে হতাশা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কথাও উল্লেখ করা হয়।
মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ সিঙ্গাপুর যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো কথা বলা থেকে তারা বিরত থাকে।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী হলো চীন। মিয়ানমার থেকে চীনে রফতানি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য প্রাকৃতিক গ্যাস, যার সবচেয়ে বড় রিজার্ভ রয়েছে রাখাইন উপকূলে। চীন ও থাইল্যান্ডে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের গ্যাস রফতানি করছে মিয়ানমার। ইউরোপীয় কমিশনের হিসাবে মিয়ানমারের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মোট বাণিজ্য প্রায় চার বিলিয়ন ডলার, যার মাঝে ইইউতে মিয়ানমারের রফতানি প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপে মিয়ানমারের মূল রফতানি দ্রব্য হলো তৈরি পোশাক ও পাদুকা। তবে করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে পশ্চিমা বাজারে মিয়ানমারের তৈরি পোশাকের সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের মোট রফতানির মাত্র ৩ শতাংশের ক্রেতা। অপরদিকে চীন ৩৩ শতাংশ, থাইল্যান্ড ১৮ শতাংশ ও জাপান ৮ শতাংশের ক্রেতা।
এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা ভারত, হংকং, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া। মোট কথা মিয়ানমারের মূল বাণিজ্য সহযোগী হলো এশিয়ার দেশগুলো। মিয়ানমার টাইমস জানায়, দেশটিতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হলো সিঙ্গাপুর। দেশটিতে গণতন্ত্রায়ন শুরু হওয়ার পর থেকে রাখাইনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্রের এই বন্ধু দেশগুলো সেখানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে ও চীনের একচেটিয়া প্রভাব কমাতে সহায়তা করেছে। এখন মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা অবরোধ বিনিয়োগকারী দেশগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভূরাজনীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা স্ট্রাটফর জানিয়েছে, মিয়ানমারের ওপর অবরোধ দেয়া ছাড়া বাইডেন প্রশাসনের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই; কিন্তু এহেন অবরোধে সেখানে মার্কিন প্রভাব আরো কমে গিয়ে চীনা প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি হয়ে দাঁড়াবে।
স্ট্রাটফরের কথায় বোঝা যাচ্ছে- গণতন্ত্র নয়, বরং চীনের সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের পশ্চিমারা মেনে নিতে বাধ্য হবে। আর সুচি ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার ‘গণতান্ত্রিক স্বরূপ’ দেখিয়েছেন। আর পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আদর্শ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতেই পারছে না।