জেনারেল হ্লাইং রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কতটা আন্তরিক

মাসুদুর রহমান
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৩৩

জেনারেল মিন অং হ্লাইং
জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দিকে এখন সবার দৃষ্টি। তিনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কতটা আন্তরিক তা নিয়ে চলছে নানান বিশ্লেষণ।
জেনারেল হ্লাইং ক্ষমতা দখলের পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে।
বেসামরিক সরকারের নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। কোনো রক্তপাত ছাড়াই মসনদে বসে সুচিসহ তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) তুলনামূলক খারাপ ফলাফল করেছে। এনএলডি আগের বারের অর্থাৎ ২০১৫ সালের চেয়েও ভালো ফল করেছে। তখন থেকেই সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে বিরোধ লেগে ছিল। বিশেষ করে সুচি ও জেনারেল হ্লাইংয়ের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত চরমে উঠেছিল। জেনারেল হ্লাইং রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বলে অভিযুক্ত। এমন এক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের চিফ এজেন্ট হিসেবে জেনারেল হ্লাইংয়ের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন সুচি।
চলতি বছরের মাঝামাঝি জেনারেল হ্লাইংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। ধারণা করা হয়, হ্লাইং সেনাবাহিনীর প্রধান পদে থাকায় সুচি আদালতে তার পক্ষে কথা বলেছেন; কিন্তু তিনি যখন এই পদে থাকবেন না, তখন সুচি জেনারেলের পক্ষে নাও অবস্থান নিতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে হ্লাইং তার নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন।
সেনাবাহিনী মিয়ানমারে ক্ষমতা দখলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে- মিয়ানমারে ভোটার তালিকায় ব্যাপক ভুল ছিল। সাড়ে তিন কোটি ভোটারের মধ্যে এক কোটি ভোটারই ভুয়া বলে ক্ষমতা দখলের পর সেনাবাহিনী উল্লেখ করেছে। সাধারণত মিয়ানমারে নির্বাচনে তেমন কোনো কারচুপি চোখে পড়ে না। ২০১৫ সালের নির্বাচনও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ফলে এবারের নির্বাচনে ভোটার তালিকায় এতটা ভুলের চিত্র অবিশ্বাস্য। তবে সেনাবাহিনী কোন বিষয়টিকে ‘ভুল’ বলে অভিহিত করেছে, সেটি স্পষ্ট নয়। এমন হতে পারে যে, কোনো নামের স্পেলিং মিসটেক কিংবা ছোটখাটো ত্রুটিকে ভুল বলে চিহ্নিত করেছে। এই অজুহাতে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া সত্যিই বিস্ময়কর।
সেনাবাহিনী বলছে, আগামী এক বছরের মধ্যে সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তারা নতুন নির্বাচন দেবে। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে; কিন্তু মিয়ানমারের ইতিহাসে এক বছরের মধ্যে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার কোনো নজির নেই। ফলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, এটা একটি কথার কথা। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল নতুন কিছুও নয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে টানা ৫০ বছর দেশটি শাসন করেছে।
জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনকালে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে কি-না, সেই প্রশ্ন এখন সবার। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা খুবই ঘৃণিত ও অবহেলিত। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় তৎকালীন সামরিক সরকার। রোহিঙ্গাদের বিতারণের কাজটিও সেনাবাহিনীই করেছে। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে বিতাড়িত করাকে জাতিসংঘ বলেছে জাতিগত নিধনযজ্ঞ। ফলে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সামরিক জান্তার আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয় না।
মিয়ানমারে গণতন্ত্র মানে হলো ক্ষমতার ভাগাভাগি। পার্লামেন্টে এক-তৃতীয়াংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত, অভিবাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সামরিক বাহিনীর হাতে রয়েছে। ফলে কথিত গণতান্ত্রিক শাসনেও প্রত্যাবাসনের চাবিকাঠি সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল; কিন্তু বাস্তবতা হলো- ২০০৫ সালের পর থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। উপরন্তু সেনাসমর্থিত ইউএসডিপি নেতা ভোটের আগে বলেছেন, তার শরীরে কোনো মুসলমানের রক্ত নেই। চাইনিজ রক্ত নেই। তিনি একজন সাচ্চা বার্মিস। এমন কট্টর বক্তব্যের পর বোঝাই যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বার্মিস সেনাবাহিনীর কোনো সহানুভূতি নেই। ভোটে রোহিঙ্গা কোনো পপুলার এজেন্ডা নয়। ফলে সুচির এনএলডি কিংবা সেনাবাহিনীর ইউএসডিপি কেউই রোহিঙ্গাদের আপন নয়। ফলে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় সানন্দ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করবে এটি ভাবা যায় না।
রোহিঙ্গাদের আগমন এবারই প্রথম নয়। ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে বড় আকারে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছিল। দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের ওই সময়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ওই উভয় সময়ে মিয়ানমারে ক্ষমতায় ছিল সামরিক সরকার। সেই কথা চিন্তা করে অনেকে মনে করেন এবারো তাদের ফিরিয়ে নেবে জান্তা সরকার। তার ওপর সুচির কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অনেকটা চাপে পড়েছে সেনাবাহিনী। তাই রোহিঙ্গা ফিরিয়ে গণহত্যার অপবাদ মোছার চেষ্টা করতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সুচির আমলে বেসামরিক সরকারের সাথে চুক্তি করলেও সামরিক বাহিনীর সম্মতি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। এসব দিক বিবেচনায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের একেবারেই নিতে চায় না, এটি বলা যায় না।
আগের দুইবারের রোহিঙ্গা ঢলের তুলনায় এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। এবার মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক নয়। যদিও তারা মুখে কখনো অস্বীকার করছে না। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলছে। চুক্তি করছে; কিন্তু ফিরিয়ে নিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের উচিত হবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো।