
চীনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ শিনজিয়াং। এখানে উইঘুর মুসলিম ও অন্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসবাস। দীর্ঘদিন ধরেই এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে আসছে চীনা কর্তৃপক্ষ। এই নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, তা দেশটির সবচেয়ে খারাপ স্বৈরশাসকের অত্যাচারের সীমাকেও অতিক্রম করেছে।
শুধু ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বেইজিং যেসব নির্মম কার্যকলাপ চালিয়েছে, তার মধ্যে জাতিগত ১০ লাখ সংখ্যালঘুকে সংশোধনের নামে বন্দি করে রাখা, ব্যাপক নজরদারি, জোরপূর্বক শ্রম আদায়, গর্ভপাতে বাধ্য করা, বন্ধ্যত্বকরণ, প্রার্থনার জায়গা ও সংখ্যালঘুদের পার্শ্ববর্তী স্থান ধ্বংস করা ও শেষকৃত্যের জায়গাগুলোকে অবমাননা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।
তবে চীন প্রশাসনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর কূটকৌশলের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা। জন্মহার কমিয়ে আনতে এই নারীদের বন্ধ্যাত্ববরণ ও আইইউডি (জরায়ুতে স্থাপনযোগ্য অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রক উপকরণ, যা কপার-টি নামেও পরিচিত) গ্রহণে বাধ্য করা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণমূলক এসব কর্মসূচির কারণে শুধু গত বছরই বেইজিং তিন কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে বলে জানিয়েছেন গবেষক আদ্রিয়ান জেনজ।
শিনজিয়াংয়ে ২০১৯ সালে জন্মহার কমেছে ২৪ শতাংশ; সে তুলনায় দেশব্যাপী এ হার কমেছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখতে চীন এসব সম্প্রদায়ের নারীকে তাদের নিশানায় রাখলেও এই নারীরাই কিন্তু উইঘুরদের স্বাধীনতা ও নিজ ক্ষমতায়নের শক্তিশালী যোদ্ধা হিসেবে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। চীনা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি সত্ত্বেও গত বছর আরো বেশি উইঘুর ও কাজাখ নারী শিনজিয়াং থেকে পালিয়ে বের হয়ে নিজেদের দুর্দশাময় অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। ২০১৯ সালে আছিয়া আব্দুলাহেদ নামের একজন উইঘুর নারী ক্যাম্পের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কিছু নথিপত্র ফাঁস করে দেয়। এ ঘটনার পর আছিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে সরকারের হুমকি-ধমকির বন্যা বয়ে যায়।
এসব নারীর নির্যাতন ও সংগ্রামের কথা এখন ছড়িয়ে পড়ছে। শিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা মার্কিন কংগ্রেস ও জাতিসংঘের পাশাপাশি গণমাধ্যমের কাছে তাদের ভয়াবহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের দেয়া এই সাক্ষ্যগুলোই উইঘুরদের পাশে দাঁড়াতে বিশ্বব্যাপী সমর্থন তৈরি করেছে ও বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে সবাই। শিনজিয়াংয়ে এসব নীতিমালা প্রণয়নের পেছনে যেসব কর্মকর্তার হাত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে গত বছর একটি আইন কার্যকর করে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের অভিযোগ থাকায় তুলা ও টমেটোসহ বেশকিছু পণ্য আমদানি বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে দেশটি।
শিনজিয়াংয়ে কর্মকাণ্ডের পরিপ্রক্ষিতে জার্মানির নেতৃত্বে ৩৯ দেশের একটি দল ২০২০ সালের অক্টোবরে বেইজিংয়ের উদ্দেশে নিন্দা প্রকাশ করে। যদিও তাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত জোরাল কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। উইঘুরদের ওপর নির্যাতনসহ আরো কিছু কারণে ২০২২ বেইজিং অলিম্পিক বয়কটের ডাক দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
বেইজিংয়ের এই নির্যাতনকে অনেক নারীই এখন শক্তিতে রূপান্তর করে নিচ্ছে। চীনের দমন-নিপীড়ন ও শিনজিয়াং সংকটের প্রাথমিক শিকারই নারী। বিশ্বকে এসব অবর্ণনীয় নির্যাতনের বিষয়ে বোঝাতে তারা এখন নেতৃত্বের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হচ্ছেন।
আসকর সর্বপ্রথম ওয়াশিংটনের রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদক গুলচেহারা হোজার সাথে দেখা করেন। হোজা নিজেও উইঘুর সম্প্রদায়ের, শিনজিয়াংয়ে দমন-নিপীড়নের প্রথম সময় থেকেই তিনি এ বিষয়ে খবর প্রচার করে আসছেন।
হোজা ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চীনের সংশোধনী ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা ওমরবেক ইলির একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। এটি ছিল বেইজিংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ এতদিন যারা বেইজিংয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত তারা মোক্ষম প্রমাণ হাতে পেয়ে যায়; কিন্তু এজন্য হোজাকে বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। যেদিন হোজা সাক্ষাৎকার নিতে বের হয়েছিলেন, সেদিন থেকেই শিনজিয়াংয়ে পরিবারের কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। কয়েকদিন পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা একজন উইঘুর শিক্ষার্থী তাকে ফোন দিয়ে জানান, হোজার মা-বাবাসহ আরো ২০ জন আত্মীয়-স্বজনকে আটক করে রাখা হয়েছে।
এ সময়টিকে নিজের জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন হোজা। নিজের কাজ অথবা জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তা যেকোনো একটি বেছে নেয়ার চাপ পড়ে তার ওপর। হোজা বলেন, ‘যখন আপনি সবকিছু হারিয়ে ফেলবেন, তখন আর কোনো কিছুতে ভয় থাকবে না। তাই আমি ভাবলাম এবার আমি নিজের গল্প বলবো’।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে তিনি অন্য উইঘুরদের জন্য উদাহারণ হয়ে ওঠেন। একে একে হোজা তার স্বজনদের ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার খবর পেতে থাকেন। মায়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলার অনুমতিও পান। অবশ্য তার বয়স্ক মা’কে মেয়ে হোজার সাথে প্রতিবার ফোনে কথা বলার আগে শিনজিয়াং পুলিশকে অবহিত করতে হতো। পরবর্তীতে হোজার সাহসী কাজের জন্য ২০২০ সালের মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল উইম্যান মিডিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কারেজ ইন জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড পান।
উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শিনজিয়াংয়ে সফরে আসার পর থেকেই এখানে চীন সরকারের নিষ্পেশন বেড়ে যায়। ২০১৭ সালে শিনজিয়াংয়ের চারপাশে ‘ইস্পাতের তৈরি দেয়াল’ নির্মাণের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট শি। চায়না কমিউনিস্ট পার্টির বস চেন কোয়ানগও প্রেসিডেন্টের এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে ব্যাপক সহযোগিতা করেন। তিব্বতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর ২০১৬ সালের আগস্টে চেন’কে শিনজিয়াংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। শিনজিয়াংয়ে চলমান দমন নিপীড়নসহ সংশোধনী ক্যাম্প স্থাপনের মূল হোতা মনে করা হয় এই চেনকে।
২০১৮ সালের শেষের দিকে চীন থেকে পালিয়ে আসা সোফিয়া (ছদ্মনাম) জানান, ক্যাম্পে যা ঘটেছিল তা বর্ণনাতীত। শিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকির একটি ক্যাম্পে সাড়ে ছয় মাস আটক ছিলেন তিনি। নথিপত্রে তাকে আটকে রাখার কারণ হিসেবে অন্যদেশে ভ্রমণকে দেখানো হয়েছে। ক্যাম্পে অনেককেই এ কারণে আটকে রাখা হয়েছে। বাকিদেরকে বিদেশে আত্মীয় থাকা, হোয়াটসঅ্যাপের মতো নিষিদ্ধ অ্যাপ ব্যবহার অথবা নিজস্ব ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য আটক করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পরেও কয়েক সপ্তাহ কথা বলতে পারছিলেন না। তিনি ছবি একে বোঝান, সেখানে কী ঘটেছিল তার সাথে। তার আঁকা ছবিতে দেখা যায়, বন্দিদের লম্বা শেকলে আটকে ক্যাম্পের উঠোনে ফেলে রাখা হয়েছে এবং নারীদের স্নানাগারেও নজরদারি ক্যামেরা লাগানো, প্রতি সপ্তাহেই এসব বন্দি নারীর পুরো শরীর তল্লাশি করা হয়। এছাড়াও তাদেরকে একধরনের ইনজেকশন নিতে বাধ্য করা হতো, আর এটি নেয়ার পর তাদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেত।
তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পের নিয়ম-কানুন ছিল কড়া। প্রতিদিন সকালে কারা পরিদর্শনের সময় ২০ জনের বেশি নারী গার্ডদের স্যালুট দিয়ে চিৎকার করে বলতো ‘শি জিনপিং দীর্ঘজীবী হোন।’ এরপর ক্লাস শুরু না হওয়ার দুই ঘণ্টা পর্যন্ত নারীদের নোংরা ম্যাট্রেসে পিঠ সোজা করে দুই হাঁটু ধরে বসে থাকতে হতো।’
এসব অত্যাচার-নির্যাতনের খবরকে তীব্রভাবে অস্বীকার করেছে বেইজিং। জোরপূর্বকভাবে আইইউডি প্রয়োগ, বন্ধ্যত্বকরণ ও গর্ভপাতের অভিযোগ নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনগুলোকে ‘অসৎ উদ্দেশ্যে ছড়ানো কলঙ্কজনক মন্তব্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন শিনজিয়াং আঞ্চলিক সরকারের উপমুখপাত্র ঝু গুইজিয়াং।
তিনি বলেন, ‘সব জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্যই স্বাধীনভাবে নিরাপদ, কার্যকর এবং সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। এ অঞ্চলে বাধ্যতামূলক বন্ধ্যত্বকরণের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।’